বার্তা সংস্থা ইকনা: যুক্তরাষ্ট্রের রুটগ্রার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘আমেরিকান এবং জেন্ডার শিক্ষা’ বিষয়ে পিএইচডি করা বিশেষজ্ঞ যিনি চীন থেকে আসা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী অভিবাসীদের কাছে থেকে বড় হয়েছেন। কিন্তু যদিও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী তারপরও তারা ততোটা ধার্মিক ছিলেন না। হাই স্কুলে থাকার সময় তাকে খ্রিস্টান বাপ্টিসমের অনুসারী করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল কিন্তু তিনি এর বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেন।
২০০১ সালে বার্কেলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যলয়ে পিএইচডি অধ্যয়রত থাকা অবস্থায় লস এঞ্জেলসে যে দাঙ্গা হয় তাতে তিনি এশিয়ান এবং আফ্রিকান-আমেরিকানদের সাথে তার যোগাযোগ আরো বেশি বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেন।
এর কিছুকাল পরেই ১১ সেপ্টেম্বর ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে।
এর পরেই তিনি মুসলিম এবং উপসাগরীয় অঞ্চলের কিছু সংগঠনের সাথে বর্ণবাদ বিরোধী প্রচারনায় অংশ নেন। ‘আমি শিঘ্রই বুঝতে পারলাম যে, বর্ণ সম্পর্কে আফ্রিকান-আমেরিকান এবং এশিয়ান-আমেরিকানদের বিষয়ে আমি অধ্যয়ন করার সময় যে প্রগতিবাদী চিন্তাধারা সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তার সবকিছুই মুসলিম সমাজের মধ্যেও বিদ্যমান।’ চান-মালিক এমনটি জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিমদের পরিচয় এবং এর সাথে যে সংস্কৃতির দূরত্ব রয়েছে তা মোচনের জন্য তাদের রাজনৈতিক মুখপাত্র থাকার ব্যাপারে যে চাওয়া সেগুলো সম্পর্কে তিনি দলিল সংগ্রহ করতে থাকেন। তার গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করতে থাকা অবস্থাতেই তিনি উপলব্ধি করেন যে, তিনি ইসলামের বিশ্বাসের প্রতি টান অনুভব করছেন এবং ২০০৪ সালেই তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হন।
তার নতুন বই ‘মুসলিম হওয়াঃ আমেরিকান ইসলামে মহিলাদের একটি রঙিন ইতিহাস’ যেটা পাঠকদের সামনে গত শতাব্দীর মুসলিম নারীদের অনেক ভুলে যাওয়া রঙিন ইতিহাস তুলে ধরেছে। তিনি শুরু করেন কালো মুসলিম নারীদের দিয়ে এবং ইসলামী জাতীয় আন্দোলন দিয়ে আর পরিশেষে তিনি উন্মোচন করেন কিভাবে ট্রাম্প সরকারের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাথে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন বর্ণের নারীরা ইসলাম পালন করে যাচ্ছেন। ‘আমেরিকার ইসলাম সম্পর্কে বলতে গেলে এখানে কালো মুসলিম নারীদের জন্য ইসলাম চর্চা করাটা একেবারেই কষ্টদায়ক।’ তিনি এমনটি জানান।
চান-মালিক রিলিজিয়ন নিউজকে ইসলামিক নারীবাদ, এর পর্দা প্রথা এবং আমেরিকান মুসলিমদের জন্য বর্ণ এবং লিঙ্গ সম্পর্কে পড়াশোনা করাটা কেন খুব কষ্টের এসব বিষয়ে একটি সাক্ষাৎকার দেন।
সাক্ষাৎকারটি ভাষান্তরে নিম্নে পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলঃ
আপনার বই জনপ্রিয় একটি বাক্য ‘মুসলিমরা আমেরিকান হও’ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মুসলিম হওয়ার দিকে দৃষ্টিপাত করতে বলে। কিভাবে আপনার ব্যক্তিগত ইতিহাস আপনার গবেষণার সাথে যুক্ত?
কিভাবে ধর্ম চর্চা করতে হয় সে সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে- আমি ধর্ম চর্চার ব্যাপারে খুবই সচেতন। এ ব্যাপারে আশপাশের লোকজন, আমার পরিবার, আমার কর্মস্থলের এমনকি যখন আমি রাস্তায় হাঁটি তখনও আশপাশের মানুষের এ বিষয়ে কি চিন্তা ভাবনা সেসব বিষয়ও পর্যবেক্ষণ করি। ‘মুসলিম হওয়াটা’ একটি বিষয়। আপনি কে, শুধুমাত্র সে বিষয় নিয়ে আপনার চিন্তা করলেই হবে না বরং আপনাকে আপনার বর্তমান পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। এ সম্পর্কে কি কি ঘটছে তাও জানতে হবে, কিভাবে মানুষ আপনার দিকে তাকাচ্ছে সে সম্পর্কেও। মুসলিম হওয়াটাকে বেছে নেয়া একটি বিদ্রোহী হওয়ার মত কাজ, এমনকি সবকিছুই যদি আপনার ক্ষতি করতে চায়, চাপের মধ্যে ফেলে দিতে চায় তা সত্বেও।
সুতারাং ‘মুসলিম হওয়াটা’ এমন কিছু যা ‘আমেরিকান হওয়ার’ বিরুদ্ধে চাওয়ার মত প্রত্যেক মুসলিম নারীর সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু বর্তমান অভিজ্ঞতা বলছে যে, পূর্বের তুলনায় বেশির ভাগ এখন মুসলিমদের সাথে সম্পর্কিত।
মুসলিম হওয়ার পূর্বে আপনার কি ‘মুসলিম হওয়ার’ মত অভিজ্ঞতা হয়েছিল?
আজিজ আনসারী নামের একজন অভিনেত্রী নিউইয়র্ক টাইমসে কিভাবে তিনি ইসলাম ত্যাগ করেছেন তা সম্পর্কে লিখেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক পরিবেশ তাকে এ কথা বলতে বাধ্য করেছিল যে, ‘ঠিক আছে যেভাবে অন্যেরা এবং আমার পরিবার আমাকে দেখে সে দিক থেকে আমি মুসলিম।’ সুতারাং তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে, তাকে তার অভিজ্ঞতা দেশটির অন্য মুসলিমদের সাথে ভাগাভাগি করা দরকার।
এটিই সেই সীমা যা এই দেশের বর্ণবাদের শিকার যারা হন তাদের অভিজ্ঞতার। যদি আপনি চিন্তা করেন কিভাবে এশিয়ান-আমেরিকানরা, আফ্রিকান-আমেরিকানরা এবং ল্যাটিন জনগণ একে অন্যের সাথে যুক্ত, এখানে সত্যিকারের কোনো সাধারণ ব্যাপার নেই তাদেরকে বিভিন্ন বর্ণে বিভক্ত করা ছাড়া।
বর্তমানে হিজাব এবং বোরকা সম্পর্কে আলোচনা ছাড়া মুসলিম নারীদের নিয়ে কথা বলতে পারবেন না। এমনটা কি সবসময়ই ছিল?
যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭০ সালের শেষের দিক থেকে এমনটা শুরু হয়েছিল। আমার নিজের গবেষণায় আমি এর পূর্বে এ সম্পর্কিত নিউইয়র্ক টাইমস ও অন্যান্য খবর বিশ্লেষণ করেছি এবং দেখেছি যে, তাদের ভ্রমণ বিষয়ক খবরে যখন তারা ভ্রমণে যায় এবং দেখতে পায় মরোক্কোতে নারীরা এভাবে পোশাক পরেন তারা এরকমটি প্রকাশ করে।
১৯৭৯ সালে এটা সত্যিকারভাবেই পরিবর্তন হতে শুরু করে তেল নিয়ে রাজনীতির শুরু হওয়া থেকে। ইরান এবং ওই অঞ্চলের সাথে আমাদের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হওয়ার পূর্বে এটাকে কখনো হুমকি হিসাবে বিবেচনা করা হতো না। সেটা অবশ্য এরকম একটি সময় ছিল যখন নারীবাদীদের আন্দোলন তাদের দ্বিতীয় ধাক্কা দেয়া শুরু করেছিল। এই বিষয়টি শ্বেতাঙ্গ নারীবাদী আন্দোলনকারীদের সাথে তেল রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়েছিল। তারা বলত, ‘আমরা সেখানে যাব এবং বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা গরীব মহিলাদের জন্য সুখকর দিক বয়ে আনব এবং তাদেরকে দেখাব যে আমাদের মূল্য তাদের চাইতে কতটা উঁচুতে।’ সুতারাং পর্দা তখন মূল্যবান এবং উপযুক্ত চিহ্নে পরিণত হয়।
সেই নারীদের যুক্ত করায় এরকম একটি প্রশ্নের ইঙ্গিত দেয় যে, ইসলাম নারীবাদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা এবং ইসলামে নারীবাদের মত এরকম বিষয় রয়েছে কিনা? কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম নারীরা এসব প্রশ্নের মোকাবেলা করেন?
গত শতাব্দীতে লিঙ্গ বৈষম্য নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো নারী ক্ষমতায়নের জন্য একটি শক্তিশালী ইচ্ছা ছিল যার মূলে ছিল ইসলামের সাথে নারীদের সম্পৃক্ত করা। এমনকি আমরা যখন রক্ষণশীল পরিবারগুলোর ঐতিহ্যগত দিকটা দেখি- তখন দেখতে পাই যে, তারা নারীদের মত প্রকাশ করা এবং ক্ষমতায়ন করার বিষয়ে ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করে। বেশীরভাগ মুসলিম নারী তাদের নারীবাদী বলেন না, তারা বলেন, ‘আমি আমার সামাজিক ক্ষমতায়নের চেষ্টা করছি।’ বা ‘আমি আল্লাহর নিকট সমর্পিত হওয়ার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছি।’ আমি যুক্তি দিব যে, এই ইচ্ছাই নারী স্বাধীনতার ভিত্তি তৈরি করবে।
কিন্তু অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নারী অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে ডাকা হয় নারীবাদী আন্দোলন নামে যা মুসলিমদের নিকট একটি বিদেশীদের চিন্তা এবং বিকল্প চিন্তাভাবনা বলে মনে হয়। সেখানে আফ্রিকান নারীরা তাদের স্বাধীনতার জন্য রীতিমত যুদ্ধ করে যাচ্ছে। তারা নারী অধিকারের্ একটি ভিন্ন ধারা চালু করেছে আমি এটাকে দেখি নারী ক্ষমতায়নের ব্যাপারে ইসলামের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী মুসলিম নারীদের আন্দোলনের সাথে একই সূত্রে গাঁথা হিসাবে।
মুসলিম নারীদের কিসের অভাব রয়েছে বলে আপনি বর্ণনা করবেন?
বিভিন্ন বর্ণের নারীরা যারা সমাজ গড়ার সাথে একেবারে গোড়া থেকে যুক্ত, বিশেষত আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম নারীরা। আমি এদের নিয়ে অনেক ভিডিও চিত্র দেখেছি, কিন্তু তারা কেউই তাদের গল্প বলার জন্য অতটা সংগ্রাম করে না। সেখানে ৭০, ৮০, ৯০ বছর বয়সী আফ্রিকান-আমেরিকান মুসলিম নারীদের পুরো একটি জাতি রয়েছে যাদের অনেক কিছুই বলার আছে। তাদের কাছে রক্ষিত আছে কিভাবে তারা তাদের কমিউনিটিতে প্রথম ইসলামিক বিদ্যালয় চালু করেছিলেন, তাদের ঘরে এ সম্পর্কিত সকল দলিল এবং আলোক চিত্র রয়েছে কিন্তু কেউই এ বিষয়ে আগ্রহী না।
আমি তরুণ মুসলিমদের এগুলো সংরক্ষণ করা, উন্মোচিত করা এবং এ সমস্ত গল্প থেকে শিক্ষা নেয়া দেখতে পছন্দ করবো।
সূত্রঃ রিলিজিয়ননিউজ.কম এর সাংবাদিক আয়শা খানকে দেয়া ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত সিলভিয়া চান-মালিক নামে একজন নারী বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার থেকে।