IQNA

দামেস্কে নবী পরিবার-বিরোধীদের মহাউৎসব!

20:38 - September 09, 2021
সংবাদ: 3470640
তেহরান (ইকনা): আবু রায়হান [আল বিরুনী] তার‘ আসারুল বাক্বিয়াহ ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে , সফর মাসের প্রথম দিন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা দামেস্কে আনা হয়। ইয়াযীদ ওই মস্তক মুবারক তার সামনে রাখে।

ইয়াজিদ ইমামের মুখ মুবারকের দাঁতগুলোতে হাতের লাঠি দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলছিল , আহ , কতইনা ভালো হতো আমার গোত্রের মধ্য থেকে যারা বদরে নিহত হয়েছিল এবং যারা [ওহুদের যুদ্ধে] খাযরাজ গোত্রকে দুমাথা ওয়ালা বর্শার আঘাতে আহত হয়ে চিৎকার করতে দেখেছিল , যদি তারা আজ এখানে উপস্থিত থাকতো। তারা আমাকে উচ্চকণ্ঠে অভিনন্দন জানাতো এবং বলতো ,‘ হে ইয়াযীদ , তোমার হাত যেন অলস না হয়ে যায় , কারণ আমরা তার [রাসূলুল্লাহ-সা.] গোত্রের সর্দারকে হত্যা করেছি। আমি তা করেছি বদরের প্রতিশোধ হিসাবে , তা এখন পরিপূর্ণ হয়েছে। বনি হাশিম সার্বভৌমত্ব নিয়ে একটি খেলা খেলেছে। কোন রিসালাহ [আল্লাহর কাছ থেকে সংবাদ] আসে নি , না এসেছে কোন ওহী। আমি খন্দক পরিবারের একজন থাকতাম না যদি আহমাদ-এর বংশধরের ওপর প্রতিশোধ না নিতাম তাদের কৃতকর্মের জন্য। ’

আবি মাখনাফ এর‘ মানাক্বিব ’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে , যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা ইয়াযীদের কাছে আনা হলো , এ থেকে একটি সুবাস ছড়িয়ে পড়লো এবং অন্য সব সুবাসকে শুষে ফেললো।

‘ বিহার ’ এবং‘ মানাক্বিব ’ -এও বর্ণিত হয়েছে ধারাবাহিক বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে যাইদ থেকে , যে বর্ণনা করেছে তার পূর্বপুরুষ থেকে যে , সাহল বিন সা ’ আদ বলেছে , আমি আমার বাড়ির উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম , যখন সিরিয়ার মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রবেশ করলাম তখন আমি একটি শহরে প্রবেশ করলাম যেখানে বেশ কিছু পানির স্রোতধারা বইছিল এবং সবুজ গাছ-গাছালি ছিলো। আমি দেখলাম শহরটিকে সাজানো হয়েছে এবং চারিদিকে আনন্দ-উল্লাস চলছে। নারীরা তাম্বুরীন ও ঢাক বাজাচ্ছিলো এবং আনন্দ-ফুর্তিতে ব্যস্ত ছিলো। আমি নিজেকে বললাম সিরিয়াবাসীদের উৎসব সম্পর্কে আমি ভালোভাবেই অবগত , অথচ এ দিনটি কোন উৎসবের দিন নয়। আমি একদল লোককে দেখলাম পরস্পর কথা বলছে। আমি তাদের কাছে গেলাম এবং বললাম , আপনারা সিরিয়াতে উৎসব করছেন অথচ এ সম্পর্কে আমি জানি না। তারা বললো , যেন তুমি মরুভূমি থেকে এসেছো ? আমি বললাম , আমি সাহল বিন সা ’ আদ , মুহাম্মাদ (সা.)-এর একজন সাহাবী। তারা বললো , হে সাহল , খুবই আশ্চর্য যে আকাশগুলোর রক্ত বৃষ্টি ঝরছে না , না পৃথিবী এর অধিবাসীদের গিলে ফেলছে। আমি তাদেরকে বললাম তারা কেন একথা বলছে , তারা বললো , কী আশ্চর্য! হোসেইনের মাথা ইরাক থেকে উপহার হিসেবে আনা হয়েছে , আর এ লোকেরা উল্লাস করছে ? আমি জিজ্ঞেস করলাম , তাদের কোন তোরণ দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছে ? তারা একটি তোরণের দিকে ইশারা করলো যার নাম ছিলো‘ বাব আস সা ’ আত ’ ।

হঠাৎ দেখলাম একটির পর একটি সামরিক পতাকা প্রবেশ করছে এবং একজন ঘোড়সওয়ার একটি লম্বা ফলাবিহীন বর্শা বহন করছে যার আগায় একটি মানুষের মাথা বসানো আছে। যার গালগুলোর সাথে , আর যে কোন ব্যক্তির চাইতে সবচেয়ে বেশী মিল রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে। মাথার পেছনে আসছিলো নারীরা , গদীবিহীন উটের ওপরে। আমি তাদের কাছে গেলাম এবং তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম , কার কন্যা তুমি ? সে বললো , আমি সাকিনাহ , হোসেইনের কন্যা। আমি বললাম , তুমি কি কিছু চাও ? আমি সাহল বিন সা ’ আদ তোমার প্রপিতামহ রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর একজন সাহাবী। সে উত্তর দিলো , মাথা বহনকারীদের বলুন যেন তারা আমাদের মাঝ থেকে সরে যায় , যেন জনতা সেদিকে তাকিয়ে ব্যস্ত থাকে এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবার তাদের দৃষ্টি থেকে মুক্তি পায়। আমি মাথা বহনকারীর কাছে গেলাম এবং বললাম , তুমি কি আমার আশা পূরণ করার পরিবর্তে চারশ আশরাফী নিতে চাও ? সে জিজ্ঞেস করলো তা কী ? আমি বললাম , এ মাথাটি এই নারীদের মাঝ থেকে দূরে সরিয়ে নাও। সে রাজী হলো এবং আশরাফীগুলো নিলো। তখন তারা মাথাটিকে একটি ট্রাঙ্কে ভরলো এবং ইয়াযীদের কাছে নিয়ে গেলো এবং আমিও তাদের সাথে সাথে গেলাম। ইয়াযীদ সিংহাসনে বসা ছিলো একটি মুকুট পরে যা ছিলো মুক্তা ও লালমনি পাথরে সজ্জিত। আর একদল গণ্যমান্য কুরাইশ ব্যক্তি তার কাছে বসা ছিলো। মাথা বহনকারী সেখানে প্রবেশ করলো এবং বললো , আমার ঘোড়ার ব্যাগ ভরে দিন সোনা ও রূপা দিয়ে। কারণ , আমি হত্যা করেছি হেফাজতে থাকা ব্যক্তিদের সর্দারকে।

পিতা-মাতার দিক বিবেচনায় শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে আমি হত্যা করেছি ― যার বংশধারা শ্রেষ্ঠ যখন বংশধারা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। একথা শুনে ইয়াযীদ বললো , তুমি যদি জানতেই যে সে ছিলো মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠ , তাহলে কেন তাকে হত্যা করেছো ? সে জবাব দিলো , আপনার কাছ থেকে একটি পুরস্কারের লোভে। ইয়াযীদ আদেশ দিলো তার মাথা বিচ্ছিন্ন করতে এবং তা করা হলো। এরপর সে ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা নিজের সামনে রাখলো এবং বললো , এসব কেমন দেখছো , হে হোসেইন ?

‘ কামিলে বাহাই ’ -এ উল্লেখ করা হয়েছে যে , নবী পরিবারকে সিরিয়ার প্রবেশদ্বারে অপেক্ষায় রাখা হয়েছিল তিন দিন। আর এ সময় শহরকে এমনভাবে সাজানো হচ্ছিলো যে তা আগে আর কখনো দেখা যায় নি। পাঁচ লক্ষ সিরিয় পুরুষ ও মহিলা নতুন পোশাক পরেছিল , সাথে ছিলো তাম্বুরীন , করতাল এবং ঢাক ; তারা নিজেদের প্রস্তুত করলো এবং তাদের দিকে এগিয়ে গেলো। সেদিন ছিলো বৃহষ্পতিবার , শহরের ভেতরে ছিলো পুনরুত্থান দিবসের মত [ভীড়] এবং সেখানে জনগণ আনন্দ-উল্লাস করছিল। যখন দিবস অগ্রসর হলো , মাথাগুলোকে শহরে প্রবেশ করানো হলো। অনেক মানুষের ভীড়ের কারণে , অনেক কষ্টে দিনের শেষে তারা ইয়াযীদ বিন মুয়াবিয়ার প্রাসাদের দরজায় পৌঁছাতে পারলো। মূল্যবান পাথরে সজ্জিত একটি সিংহাসন ইয়াযীদের জন্য রাখা হয়েছিল এবং তার বাড়ি সাজানো হয়েছিল এবং সোনালী ও রূপালী চেয়ারগুলো তার সিংহাসনকে ঘিরে রাখা হয়েছিল। ইয়াযীদের সেবকরা মাথা বহনকারীদের প্রবেশ করতে বললো , আর তারা তা পালন করলো। তারা বললো , অধিনায়কের ইযযতের শপথ , আমরা আবু তুরাব [আলী]-এর সন্তানকে হত্যা করেছি এবং তাদের বংশধারা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছি। এরপর তারা পুরো ঘটনা বর্ণনা করলো এবং তার সামনে মাথাগুলো রাখলো। আহলে বাইত (আ.)-কে দীর্ঘ সময়ের জন্য বন্দী করে রাখা হয়েছিল , ছেষট্টিদিন যাবৎ এবং এ সময়ে কেউ তাদের সালাম জানাতে পারে নি। সেদিন এক বৃদ্ধ ব্যক্তি ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-এর কাছে গেলো এবং বললো , সব প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি তোমাদের হত্যা করেছেন ও ধ্বংস করেছেন এবং বিদ্রোহের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন।

শইখ মুফীদ বলেন যে , যখন তারা ইয়াযীদের প্রাসাদের দরজায় পৌঁছলো তখন মাখফার বিন সা ’ লাবাহ উচ্চকণ্ঠে বললো , আমি মাখফার বিন সা ’ লাবাহ , আমি এ নোংরা সীমালঙ্ঘনকারীদের [আউযুবিল্লাহ] এনেছি ইয়াযীদের কাছে।

একথা শুনে ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) বললেন , মাখফারের মায়ের সন্তান হলো সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে নীচ।

অত্যাচারী সিরিয়ার নাগরিকরা বললো , আমরা কখনো এত সুন্দর বন্দী দেখি নি। তোমরা কারা ? ইমাম হোসেইন (আ.)-এর কন্যা সাইয়েদা সাকিনাহ (আ.) উত্তর দিলেন ,“ আমরা মুহাম্মাদ (সা.)-এর বন্দী পরিবার।” তাদেরকে এবং ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-কে আটকে রাখা হলো মসজিদের সিঁড়িঘরে। তিনি তখন অল্প-বয়সী যুবক ছিলেন। সিরিয়াবাসীদের মধ্যে এক বৃদ্ধ এগিয়ে এলো এবং বললো ,“ সব প্রশংসা আল্লাহর যে তিনি তোমাদেরকে হত্যা করেছেন ও ধ্বংস করেছেন এবং বিদ্রোহের আগুনকে নিভিয়ে দিয়েছেন।” এরপর সে যা ইচ্ছা বলতে থাকলো এবং যখন সে চুপ হলো , ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) তাকে বললেন ,“ তুমি কি আল্লাহর কুরআন পড়েছো ?” সে হ্যাঁ বললো। তিনি বললেন , তুমি কি এ আয়াত পড়েছো:

) ق ُل لَّا أَسْأَلُكُمْ عَلَيْهِ أَجْرً‌ا إِلَّا الْمَوَدَّةَ فِي الْقُرْ‌بَىٰ(

বলো [হে আমার রাসূল]: আমি তোমাদের কাছে কিছু দাবী করি না [নবুয়তের পরিশ্রমের জন্য] শুধু আমার রক্তের আত্মীয়দের প্রতি ভালোবাসা ছাড়া। [সূরা শুরা: ২৩]

সে বললো , হ্যাঁ , আমি পড়েছি। ইমাম (আ.) বললেন , আমরাই সেই পরিবার থেকে। এছাড়া এ আয়াত তুমি কি পড়ো নি:

) و َآتِ ذَا الْقُرْ‌بَىٰ حَقَّهُ(

এবং দিয়ে দাও তোমার রক্তের আত্মীয়দের অধিকার। [সূরা বনি ইসরাইল: ২৬]

সে বললো সে তা পড়েছে। ইমাম সাজ্জাদ (আ.) বললেন , আমরা তাদের অন্তর্ভুক্ত। এরপর তিনি বললেন , তুমি কি এ আয়াত পড়ো নি:

) إ ِنَّمَا يُرِ‌يدُ اللَّـهُ لِيُذْهِبَ عَنكُمُ الرِّ‌جْسَ أَهْلَ الْبَيْتِ وَيُطَهِّرَ‌كُمْ تَطْهِيرً‌ا(

আল্লাহ তো শুধু চান তোমাদের কাছ থেকে অপবিত্রতা দূরে রাখতে হে আহলে বাইত এবং তোমাদের পবিত্র করতে চান পুত: পবিত্রের মতো। [সূরা আহযাব: ৩৩]

সে বললো , কেন নয় ? ইমাম বললেন , আমরাই তারা যাদের কথা এখানে বলা হয়েছে। একথা শুনে সিরিয় ব্যক্তি তার দুহাত আকাশের দিকে তুলে বললো ,

হে আল্লাহ , আমি আপনার সামনে নিজেকে মুহম্মাদ (সা.)-এর সন্তানদের শত্রু ও হত্যাকারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করছি। আমি সব সময় কোরআন পড়েছি কিন্তু আজকে পর্যন্ত এর ওপরে আমি গভীরভাবে ভাবি নি।

আমাদের উস্তাদ শেইখ সাদূক বর্ণনা করেছেন ফযল বিন শাযান থেকে যিনি বলেছেন যে , আমি ইমাম আলী আল রিদা (আ.)-কে বলতে শুনেছি যে ,“ যখন ইমাম হোসেইন (আ.)-এর মাথা সিরিয়াতে নেওয়া হলো , ইয়াযীদ আদেশ দিলো তা মাটিতে রাখার জন্য এবং একটি দস্তরখান এর সামনে বিছানো হলো। সে এরপর তার সাথীদেরসহ এর দিকে ফিরে খাবার খাচ্ছিলো এবং মদ পান করেছিল। যখন তারা শেষ করলো , সে ট্রে-টিকে তার সিংহাসনের নিচে রাখতে আদেশ দিলো। এরপর সে সিংহাসনের ওপরেই পাশা খেলার বোর্ড বিছালো এবং খেলা শুরু করলো। সে টিটকারী করতে লাগলো ইমাম হোসেইন (আ.) , তার পিতা (আ.) এবং তার নানার (সা.) নাম উল্লেখ করে এবং সে জিতলো। সে এর জন্য মদ পান করলো। তিনবার সে মদ পান করলো এবং এরপর কিছুটা ট্রের কাছে ছুঁড়ে মারলো। অতএব যে আমাদের শিয়া [অনুসারী] , যখন তার দৃষ্টি পড়বে মদ ও পাশার দিকে , সে ইমাম হোসেইন (আ.)-কে স্মরণ করবে , আর ইয়াযীদ ও তার বংশকে অভিশাপ দিবে , আল্লাহ তার গুনাহগুলো ক্ষমা করে দিবেন যদি তা তারাগুলোর সংখ্যার সমানও হয়।

অভিশপ্ত ইয়াযীদের সামনে সাইয়েদা যায়নাব (আ.)-এর খোতবা

বর্ণনাকারী বলেছে যে , ইমাম আলী বিন আবি তালিব (আ.)-এর কন্যা সাইয়েদা যায়নাব (আ.) উঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন , সব প্রশংসা জগতসমূহের প্রতিপালকের জন্য এবং শান্তি বর্ষিত হোক তাঁর রাসূল এবং তার বংশধরদের সবার ওপর। কত সত্যই না আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেছেন:

) ث ُمَّ كَانَ عَاقِبَةَ الَّذِينَ أَسَاءُوا السُّوأَىٰ أَن كَذَّبُوا بِآيَاتِ اللَّـهِ وَكَانُوا بِهَا يَسْتَهْزِئُونَ(

“ এরপর অত্যন্ত খারাপ পরিণতি হলো তাদের যারা খুব খারাপ কাজ করেছে , কারণ তারা আল্লাহর নিদর্শনগুলোকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছে এবং তাদের প্রতি তারা টিটকারী করতো।” [সূরা রূম: ১০]

হে ইয়াযীদ , এখন যেহেতু তুমি পৃথিবীর পথ ও আকাশের দিগন্তকে আমাদের ওপর বন্ধ করে দিয়েছো এবং আমাদেরকে কয়েদীদের মতো তাড়িয়ে এনেছো। তুমি কি মনে করো যে তুমি আমাদেরকে আল্লাহর কাছে বেইযযতি করেছো এবং তোমাকে প্রিয় করেছো ? আর তুমি এর কারণে আল্লাহর কাছে সম্মান ও উচ্চ মর্যাদা লাভ করেছো ? আর তাই তুমি আমাদেরকে নীচু মনে করে তাকাচ্ছো এবং অহংকারী , আনন্দিত ও উচ্ছসিত হচ্ছো যে পৃথিবী তোমার দিকে ফিরে এসেছে ? তুমি মনে করেছো যে তোমার কাজ গোছানো , আর সার্বভৌমত্ব ও রাজ্য তোমার জন্য প্রীতিকর ? মনে হচ্ছে তুমি ধীরে ধীরে সর্বশক্তিমান ও পবিত্র আল্লাহর কথাগুলো ভুলে গেছো , যারা অবিশ্বাসী তারা যেন মনে না করে যে তাদেরকে আমরা যে সময় দিচ্ছি তা তাদের জন্য কল্যাণকর ; আমরা তাদের শুধু সময় দেই এজন্যে যে তারা যেন গুনাহতে বৃদ্ধি পায় , আর তাদের জন্য আছে অপমানকর শাস্তি। এটিই কি ন্যায়বিচারের সংস্কৃতি যে তুমি তোমার পরিবারের নারীদের এবং নারী গৃহকর্মীদের পর্দার আড়ালে বসাবে আর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কন্যাদের বন্দী করবে , তাদেরকে প্রদর্শনী বানাবে ? তুমি তাদের বোরখা ছিনিয়ে নিবে আর তাদেরকে বেআব্রু করে রাখবে , আর তাদের শত্রুরা তাদেরকে অন্যদের সামনে প্রদর্শন করে বেড়াবে এক শহর থেকে আরেক শহরে এবং প্রত্যেক নদী ও শহরের অধিবাসীরা তাদেরকে এক নজর দেখবে ? এবং তাদের দিকে তাকাবে প্রত্যেক ঘনিষ্ঠ ও অঘনিষ্ঠ মানুষ , নীচ ও সম্মানিত লোকেরাও , যখন তাদের সাথে থাকবে না পুরুষ অথবা নির্ভরযোগ্য কোন ব্যক্তি ? কী তাক্বওয়া আমরা তাদের কাছ থেকে আশা করতে পারি যারা পরহেযগারদের [মুত্তাকীদের] কলিজা খেয়েছে এবং যাদের গায়ে মাংস গজিয়েছে শহীদদের রক্ত [পান] থেকে ? কীভাবে সে আমাদের প্রতি তার ঈর্ষা কমাবে , যে আমাদের আহলুল বাইতের দিকে তাকায় দাম্ভিকতা , শত্রুতা এবং ঘৃণার দৃষ্টিতে ? এবং সে বীরত্বের সাথে ঘোষণা করে যে , তারা আমাকে উচ্চকণ্ঠে অভিনন্দন জানাতো এবং বলতো:“ হে ইয়াযীদ , তোমার হাত দুটো যেন অলস না হয়ে যায় , এরপর তুমি আবু আব্দুল্লাহ (আ.) , যিনি জান্নাতের সর্দার , তার দাঁতের দিকে মনোযোগ দিয়েছো এবং এতে আঘাত করেছো তোমার হাতের কঞ্চি দিয়ে ? তাই এরকম কেনইবা তুমি বলবে না ? তুমি আঘাতকে এর গভীরতম তলায় পৌঁছে দিয়েছো এবং আদি উৎসকে উপড়ে ফেলেছো রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তান ও আব্দুল মোত্তালিবের বংশ থেকে পৃথিবীর নক্ষত্রদের একজনের রক্ত ঝরানোর মাধ্যমে। এরপর তুমি উচ্চকণ্ঠে তোমার পূর্বপুরুষদের সম্বোধন করেছো এবং তোমার অনুমানে তাদেরকে ডেকে আনছো ? খুব শীঘ্রই তুমিও তাদের শেষ পরিণতির সম্মুখীন হবে। আর তখন তুমি বলবে , হায় যদি তুমি অবশ হতে এবং বোবা হতে তাহলে তো একথাগুলো বলতে হতো না এবং এমন চরিত্র তোমার হতো না।

হে আল্লাহ , আমাদের অধিকারকে তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিন এবং আমাদের ওপর যারা অত্যাচার করেছে তাদের ওপর প্রতিশোধ নিন এবং আপনার গযব পাঠান তাদের ওপরে যারা আমাদের রক্ত ঝরিয়েছে এবং আমাদের সাহায্যকারীদের হত্যা করেছে। আল্লাহর শপথ , তুমি তোমার নিজের চামড়া ছিঁড়েছো এবং তোমার নিজের মাংস টেনে ছিঁড়েছো এবং তুমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সন্তানের রক্ত ঝরানোর এবং তার পরিবার ও অনুসারীদের পবিত্রতা লঙ্ঘনের বিরাট বোঝা নিয়ে তার সামনে যাবে ― এমন জায়গায় যেখানে আল্লাহ জড়ো করবেন তাদের ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়াদের এবং সংখ্যা বৃদ্ধি করবেন তাদের মধ্যে যারা ছড়িয়ে পড়েছিল , আর তাদের কাছে তাদের অধিকার উপহার দিবেন ,

) و َلَا تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللَّـهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِندَ رَ‌بِّهِمْ يُرْ‌زَقُونَ(

“ এবং ভেবো না যারা আল্লাহর পথে নিহত হয়েছে তারা মৃত , বরং তারা জীবিত , তাদের রবের সাথে আছে ― রিযক্ব লাভ করছে।” [আল ইমরান: ১৬৯

আল্লাহ তোমার ওপরে বিচারক হিসাবে যথেষ্ট এবং রাসূল হবেন তোমার শত্রু এবং তিনি জীবরাঈলের সমর্থন পাবেন। খুব শীঘ্রই তোমার বাবা , যে তোমাকে রাজ্য প্রস্তুত করে দিয়ে গেছে এবং তোমাকে মুসলমানদের ঘাড়ে বসিয়ে গেছে , বুঝতে পারবে অত্যাচারীদের জন্য কত খারাপ এক জায়গা অপেক্ষা করছে।

কী খারাপ স্থানই না তুমি অর্জন করেছো এবং কী দুর্বল সামরিক বাহিনীইনা তোমার। যা হোক , অপ্রীতিকর পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছে তোমার সাথে কথা বলতে , যখন আমি মনে করি তোমার স্থান অত্যন্ত নিচে এবং তোমার তিরস্কার খুবই বড় এবং এও চাই যে তোমাকে অনেক তাচ্ছিল্য করি। কিন্তু চোখগুলো ফুলে উঠেছে এবং হৃদয়গুলো ছিটকে বেরিয়ে যেতে চায়। সাবধান , এটি আশ্চর্য যে আল্লাহর কাছে মর্যাদাবান ব্যক্তিদের দলটিকে হত্যা করবে মুক্তদের সেনাবাহিনী ― যারা শয়তান। এ হাতগুলোই আমাদের রক্ত মুঠোয় চেপে ধরেছে এবং এ চোয়ালগুলোই আমাদের মাংস গোগ্রাসে খেয়েছে। আর এগুলো হলো পবিত্র ও জ্যোতির্ময় লাশসমূহ যেগুলোকে এখন পাহারা দিচ্ছে নেকড়েরা এবং হায়েনাগুলো বার বার বালি ছিটিয়ে দিচ্ছে তাদের দেহের ওপর। আর এখন তুমি মনে করছো আমরা তোমার গনিমত ,

) ذ َٰلِكَ بِمَا قَدَّمَتْ يَدَاكَ وَأَنَّ اللَّـهَ لَيْسَ بِظَلَّامٍ لِّلْعَبِيدِ(

“ এটি হচ্ছে সে কারণে যা তোমাদের হাত সামনে পাঠিয়েছিল [যা তোমরা তোমাদের জীবনে করেছিলে] এবং আল্লাহ তার দাসদের প্রতি কখনো জুলুম করেন না।” [সূরা হাজ্ব: ১০]

আমি আল্লাহর কাছে অভিযোগ করি এবং শুধু তাঁর ওপরেই নির্ভর করি। এরপর তুমি তোমার যে কোন ফাঁদ পাততে পারো এবং তোমার ইচ্ছানুযায়ী যে কোন পদক্ষেপ নিতে পারো এবং চেষ্টা করে যাও যত চাও। আল্লাহর শপথ , তুমি কখনোই আমাদের কথা মুছে ফেলতে পারবে না এবং ওহীকে আমাদের মাঝ থেকে উৎখাত করতে পারবে না , না তুমি এ ঘটনার লজ্জাকে মুছে ফেলতে পারবে। তোমার অভিমত ভ্রান্তিপূর্ণ এবং তোমার দিনগুলো কম। আর তোমার দল ছত্রভঙ্গ থাকবে যেদিন আহ্বানকারী আহ্বান করবে: জেনে রাখো ,

) أ َلَا لَعْنَةُ اللَّـهِ عَلَى الظَّالِمِينَ(

নিশ্চয়ই আল্লাহর অভিশাপ জালিমদের ওপরে। [সূরা হুদ: ১৮]

সব প্রশংসা আল্লাহর যিনি জগতসমূহের সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক , যিনি আমাদের শুরুতে শান্তি বর্ষণ করেছেন এবং যিনি শাহাদাতকে বরকতসহ আমাদের পরিণতি হিসাবে নির্ধারণ করেছেন। আমি আল্লাহর কাছে চাই যেন তিনি তাঁর পুরস্কারকে তাদের জন্য পূর্ণ করেন এবং তা আরো বৃদ্ধি করে দেন এবং তাদের উত্তরাধিকার হিসেবে আমাদের ওপর সদয় হয়ে ফেরেন , কারণ তিনি ক্ষমাশীল ও একজন বন্ধু।

) ح َسْبُنَا اللَّـهُ وَنِعْمَ الْوَكِيلُ(

“ আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি হলেন শ্রেষ্ঠ নিরাপত্তাদানকারী।”

[সূরা আল ইমরান: ১৭৩]

সাইয়েদা যায়নাব (আ.)-এর এ দীর্ঘ ও গুরুভার বক্তব্যের উত্তরে ইয়াযীদ বললো , শোকার্ত নারীর বিলাপ প্রশংসনীয় , কিন্তু মৃত্যু বিলাপরত নারীর জন্য আরো সহজ।

শেইখ মুফীদ বর্ণনা করেছেন সাইয়েদা ফাতেমা বিনতে হোসেইন (আ.) থেকে যে , যখন আমরা ইয়াযীদের সামনে বসেছিলাম , সে আমাদের অবস্থা দেখে করুণা প্রকাশ করলো। সিরিয়াবাসীদের মধ্যে লাল চেহারার একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললো ,“ হে বিশ্বাসীদের আমির [আউযুবিল্লাহ] আমাকে এ মেয়েটি উপহার দিন , এবং‘ এ ’ বলার মাধ্যমে সে আমাকে বুঝাচ্ছিলো। আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম এবং অনুমান করলাম যে এ কাজ তাদের জন্য সহজ। আমি আমার ফুফু যায়নাব (আ.)-এর কোলে সেঁটে রইলাম , যিনি অবশ্য জানতেন তা কখনো ঘটবে না। আমার ফুফু সিরিয় ব্যক্তিকে বললেন , আল্লাহর শপথ , তুমি মিথ্যা বলছো , আর তুমি তোমার নীচ প্রকৃতির প্রকাশ ঘটিয়েছো। তোমার এবং তার কোন ক্ষমতা নেই তা করার। ইয়াযীদ ক্রুদ্ধ হয়ে বললো ,“ তুমি মিথ্যা কথা বলছো , আল্লাহর শপথ , আমার এ কাজ করার অধিকার আছে।” সাইয়েদা যায়নাব (আ.) উত্তর দিলেন ,“ না , আল্লাহর শপথ , আল্লাহ তোমাকে এ ক্ষমতা দেন নি , যদি না তুমি আমাদের উম্মত পরিত্যাগ করো এবং অন্য কোন ধর্ম গ্রহণ করো।” এ কথা শুনে ইয়াযীদের রাগ দ্বিগুণ হলো এবং চিৎকার করে বললো ,“ তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলো ? অবশ্যই তোমার বাবা ও তোমার ভাই-ই ধর্ম ত্যাগ করেছিল [আউযুবিল্লাহ] ।” সাইয়েদা যায়নাব (আ.) বললেন ,“ তুমি যদি মুসলমান হয়ে থাকো , এবং তোমার দাদা ও বাবা , তাহলে আল্লাহর ধর্মের সঠিক পথ পেয়েছো , যা আমার বাবা ও আমার ভাইয়ের ধর্ম।” একথা শুনে ইয়াযীদ বললো ,“ হে আল্লাহর শত্রু [আউযুবিল্লাহ] , তুমি মিথ্যা বলছো।” সাইয়েদা যায়নাব বললেন ,“ সার্বভৌমত্ব এখন তোমার , আর তুমি জুলুমের মাধ্যমে গালি দিচ্ছো এবং তুমি যেকোন ব্যক্তিকে তিরস্কার করছো তোমার শাসন ক্ষমতার শক্তি দিয়ে।” ইয়াযীদ এ কথা শুনে লজ্জা পেলো এবং চুপ করে রইলো। তখন সিরিয় ব্যক্তিটি আবার অনুরোধ করলো তাকে মেয়েটি উপহার দেয়ার জন্য। ইয়াযীদ চিৎকার করে বললো ,“ বের হ , তোকে যেন আল্লাহ হত্যা করে।”

ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.)-এর খোতবা

দামেস্কে বন্দী থাকা অবস্থায় ইমাম আলী ইবনে হোসেইন (আ.) ইয়াযিদকে বলেছিলেন সে যেন জুমার দিনে খুতবার দেওয়ার অনুমতি দেয়। ‘বিহার আল আনওয়ার’ গ্রন্থে উদ্ধৃত আছে এবং ‘মানাক্বিব’-এর লেখক এবং অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন যে, ইয়াযীদ একটি মিম্বর তৈরী করতে বললো এবং এরপর একজন বক্তাকে ডেকে পাঠালো। সে তাকে আদেশ করলো ইমাম হোসেইন (আ.) ও ইমাম আলী (আ.)-কে তিরস্কার করার জন্য এবং তাদের কাজকর্ম সম্পর্কে জনতার সামনে বলার জন্য। বক্তা মিম্বরে উঠলো এবং আল্লাহর হামদ ও তাসবিহ করলো এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসেইন (আ.)-কে প্রচুর গালিগালাজ করলো। এরপর দীর্ঘ সময় ধরে মুয়াবিয়া ও ইয়াযীদের প্রশংসা করলো এবং তারা অনেক ভালো কাজ করেছে বলে উল্লেখ করলো। তখন ইমাম আলী বিন হোসেইন (আ.) তাকে উচ্চকণ্ঠে বললেন, “হে তুমি, যে ওয়াজ করছো, দুর্ভোগ হোক তোমার, তুমি সৃষ্টিকর্তার ক্রোধ ডেকেছো সৃষ্টিকে খুশী করতে গিয়ে, আর তোমার স্থান হলো জাহান্নামে। এরপর তিনি ইয়াযীদের দিকে ফিরলেন এবং বললেন, তুমি কি আমাকে অনুমতি দিচ্ছো কিছু বলার জন্য যা আল্লাহর জন্য সন্তুষ্টির এবং যারা উপস্থিত আছে তাদের জন্য হবে পুরস্কার?” ইয়াযীদ তা প্রত্যাখ্যান করলো, কিন্তু জনতা বললো, “তাকে অনুমতি দিন মিম্বরে ওঠার জন্য, হয়তোবা আমরা তার কাছ থেকে [মূল্যবান] কিছু শুনতে পাবো।” ইয়াযীদ বললো, “যদি আমি তাকে অনুমতি দিই মিম্বরে ওঠার জন্য সে তা থেকে নামবে না যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আমাকে ও আবু সুফিয়ানের বংশকে অপমানিত করবে।” তারা বললো, কিভাবে এ অসুস্থ যুবক তা করবে? ইয়াযীদ বললো, “সে এমন এক পরিবার থেকে এসেছে যারা শিশুকালেই দুধের সাথে প্রজ্ঞা পান করেছে।” তারা তাকে চাপ দিতে থাকলো যতক্ষণ না সে তাতে রাজী হলো। ইমাম (আ.) মিম্বরে উঠলেন, তিনি আল্লাহর হামদ ও তাসবিহ করলেন এবং একটি খোতবা দিলেন যা চোখগুলোকে কাঁদালো এবং হৃদয়গুলোকে কাঁপিয়ে দিলো। এরপর তিনি বললেন,

“হে জনতা, আমাদেরকে ছয়টি গুণাবলী ও সাতটি মর্যাদা দেওয়া হয়েছে [আল্লাহর পক্ষ থেকে]―জ্ঞান, সহনশীলতা, উদারতা, বাগ্মিতা, সাহস ও বিশ্বাসীদের অন্তরে আমাদের জন্য ভালোবাসা―যা আমাদের মাঝে উপস্থিত। আর আমাদের মর্যাদাগুলো হলো যে, যে রাসূল দায়িত্বে আছেন তিনি আমাদের মাঝ থেকে; সত্যবাদী [ইমাম আলী] আমাদের মাঝ থেকে; যিনি ওড়েন [জাফর আত তাইয়ার] তিনি আমাদের মাঝ থেকে, আল্লাহর সিংহ এবং তাঁর রাসূলেরও― আমাদের মাঝ থেকে; আর উম্মতের দুই সিবত আমাদের মাঝ থেকে। যারা আমাকে জানে তারাতো আমাকে জানেই; যারা আমাকে চেনে না, আমি তাদের জন্য আমার বংশধারা ও পুর্বপুরুষদের পরিচয় প্রকাশ করছি যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা আমাকে চিনতে পারে। হে জনতা, আমি মক্কা ও মিনার সন্তান, আমি যমযম ও সাফা-এর সন্তান। আমি তার সন্তান যিনি কালো পাথরকে [হাজর আল আসওয়াদ] তুলেছিলেন তার কম্বলের প্রান্ত ধরে। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি সুন্দর করে পাজামা ও আলখাল্লা পড়তেন। আমি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি কাবা তাওয়াফ করেছেন, সাঈ করেছেন। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যিনি হজ্ব করেছেন এবং তালবিয়া উচ্চারণ করেছেন। আমি তার সন্তান যাকে রাতের বেলা মাসজিদুল আকসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল [মেরাজের সময়], আমি তার সন্তান যাকে সিদরাতুল মুনতাহাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, আমি তার সন্তান যে-

)ثُمَّ دَنَا فَتَدَلَّىٰ(

“এরপর নিকটবর্তী হলো এবং আরো নিকটবর্তী।” [সূরা নাজম: ৮]

আমি তার সন্তান যে ছিলো-

)كَانَ قَابَ قَوْسَيْنِ أَوْ أَدْنَىٰ(

“দুই ধনুক পরিমাণ [পরস্পর মুখোমুখি] অথবা তার চাইতেও কাছে।” [সূরা নাজম: ৯]

আমি তার সন্তান যাকে সর্বশক্তিমান ওহী দান করেছিলেন, যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমি হোসেইন (আ.)-এর সন্তান―যাকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছে; আমি আলীর সন্তান―যিনি মুর্তাযা [অনুমোদনপ্রাপ্ত]; আমি মুহাম্মাদের সন্তান―যাকে বাছাই করা হয়েছিল; আমি ফাতেমাতুয যাহরা (আ.)-এর সন্তান, আমি সিদরাতুল মুনতাহার সন্তান, আমি শাজারাতুল মুবারাকাহ [বরকতময় গাছ]-এর সন্তান, আমি তার সন্তান যার শোকে রাতের অন্ধকারে জিনরা বিলাপ করেছিল, আমি তার সন্তান যার জন্য পাখিরা শোক পালন করেছিল।”

‘কামিলে বাহাঈ’ গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে যে, ইমাম যায়নুল আবেদীন (আ.) ইয়াযীদকে বলেছিলেন যে সে যেন তাকে জুম’আর দিন খোতবা দিতে দেয়। এতে সে রাজী হয়েছিল। জুম’আর দিন ইয়াযীদ এক অভিশপ্তকে আদেশ করলো মিম্বরে উঠতে এবং ইমাম আলী (আ.) ও ইমাম হোসেইন (আ.)-কে যত পারে তত গালি দিতে এবং খলিফা উমর ও খলিফা আবু বকরের প্রশংসা করতে। অভিশপ্ত ব্যক্তিটি মিম্বরে উঠলো এবং তার যা ইচ্ছা বললো। তখন ইমাম (আ.) বললেন, “আমাকে অনুমতি দাও খোতবা দেওয়ার জন্য।” ইয়াযীদ তার প্রতিশ্রতি রক্ষা করতে অস্বীকার করলো এবং তাকে অনুমতি দিলো না। জনতা চাপ প্রয়োগ করলো, কিন্তু সে অনুমতি দিলো না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার নাবালক সন্তান মুয়াবিয়া বললো, হে বাবা, তার খোতবা কোন দিকে নিয়ে যেতে পারে? তাকে খোতবা দেওয়ার জন্য অনুমতি দিন। ইয়াযীদ বললো, “তুমি তাদের কাজ সম্পর্কে জানো না, তারা প্রজ্ঞা ও বাগ্মীতা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। আর আমি আশঙ্কা করি তার খোতবা হয়তো বিদ্রোহের সৃষ্টি করতে পারে এবং আমাদের মাথার ওপরে ঘুরতে পারে।” এরপর সে তাকে অনুমতি দিলো। ইমাম (আ.) মিম্বরে উঠলেন এবং বললেন, “প্রশংসা আল্লাহর যার কোন শুরু নেই এবং যিনি চিরস্থায়ী যার কোন শেষ নেই, তিনি সবার প্রথমে যাঁর কোন শুরু নেই এবং তিনি সবার শেষে যার শেষের কোন শেষ নেই, সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে শুধু তাঁর সত্তা ছাড়া, তিনি দিন ও রাতের পরিমাপ নির্ধারণ করেন, পরিণতি প্রস্তুত করেন এবং বরকতময় হলেন আল্লাহ, তিনিই একমাত্র বাদশাহ, সর্বজ্ঞানী।”

এরপর বললেন, “আল্লাহ আমাদেরকে দান করেছেন জ্ঞান, সহনশীলতা, উদারতা, বাগ্মীতা, সাহস এবং বিশ্বাসীদের অন্তরে ভালোবাসা। আর আমাদের মর্যাদা হলো, যে রাসূল দায়িত্বে আছেন তিনি আমাদের মাঝ থেকে, এ ছাড়াও শহীদদের সর্দার [হামযা] এবং জাফর, যিনি বেহেশতে ওড়েন এবং এ উম্মতের দুই সিব্ত [ইমাম হাসান ও ইমাম হোসেইন-আ.] আমাদের মাঝ থেকে এবং মাহদী (আ.)-ও যিনি ‘দাজ্জাল’-কে হত্যা করবেন। হে জনতা, যারা আমাকে চিনে তারাতো চিনেই, আর যারা আমাকে চিনো না, তাদের জন্য আমার বংশবৃক্ষ ও পূর্বপুরুষের পরিচয় দিচ্ছি যতক্ষণ না তারা আমাকে চিনতে পারে। হে জনতা, আমি মক্কা ও মিনার সন্তান, আমি যমযম ও সাফা-এর সন্তান, আমি তার সন্তান যিনি তার কম্বলের পাশ ধরে হাজর আল-আসওয়াদ [কালো পাথর] তুলেছিলেন। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সন্তান যার কারণে পাজামা ও আলখাল্লা সৌন্দর্য পেয়েছিল। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সন্তান যারা [কা’বা] তাওয়াফ করেছিল এবং সাঈ করেছিল। আমি সেই শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের সন্তান যারা হজ্ব সম্পাদন করেছিল এবং তালবিয়াহ উচ্চারণ করেছিল। আমি তার সন্তান যাকে রাতে মসজিদুল আক্বসাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল [মেরাজে]। আমি তার সন্তান যাকে সিদরাতুল মুনতাহাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আমি তার সন্তান যে নিকটবর্তী হলো এবং স্থির হয়ে রইলো [সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টির মাঝে মেরাজের রাতে], আমি তার সন্তান, যে ছিলো নিকটে―দুই ধনুক পরিমাণ দূরত্বে অথবা তারও কাছে [সামনা সামনি]। আমি তার সন্তান যাকে সর্বশক্তিমান আল্লাহ ওহী পাঠিয়েছিলেন, যা তিনি প্রকাশ করেছিলেন। আমি সন্তান হোসেইন (আ.)-এর―যাকে কারবালায় হত্যা করা হয়েছে, আমি সন্তান আলীর―যাকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে [মুরতাযা], আমি সন্তান মুহাম্মাদ (সা.)-এর―যিনি ছিলেন নির্বাচিত, আমি সন্তান ফাতেমা যাহরা [জোতির্ময়] (আ.)-এর, আমি সন্তান সিদরাতুল্ মুন্তাহার, আমি সন্তান শাজারাতুল মুবারাকাহর [পবিত্র বৃক্ষের], আমি সন্তান তার যাকে রক্তে ও বালিতে মাখা হয়েছে, আমি সন্তান তার যার জন্যে জিনরা বিলাপ করেছে রাতের অন্ধকারে, আমি সন্তান তার যার জন্যে পাখিরা শোক পালন করেছে।” যখন খোতবা এ পর্যায়ে পৌঁছলো জনতা কাঁদতে ও বিলাপ করতে শুরু করলো এবং ইয়াযীদ আশঙ্কা করলো এতে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যেতে পারে। সে মুয়াযযিনকে ডেকে বললো, নামাযের ঘোষণা দাও। মুয়াযযিন উঠলো এবং বললো, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। ইমাম বললেন, “আল্লাহ শ্রেষ্ঠতর এবং সর্বোচ্চ, সবচেয়ে সম্মানিত এবং সবচেয়ে দয়ালু তার চাইতে যা আমি ভয় করি এবং যা আমি এড়িয়ে যাই। এরপর সে বললো, আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। ইমাম বললেন, নিশ্চয়ই আমিও সাক্ষ্য দিচ্ছি অন্যদের সাথে যে আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং তিনি ছাড়া কোন মালিক নেই, আর আমি প্রত্যেক অস্বীকারকারীকে প্রত্যাখ্যান করি। যখন সে বললো, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল, ইমাম নিজের মাথা থেকে পাগড়ী নামিয়ে নিলেন এবং মুয়াযযিনের দিকে ফিরে বললেন, আমি এ মুহাম্মাদের (সা.) নামে অনুরোধ করছি, এক মুহূর্ত নীরব থাকার জন্য।” এরপর তিনি ইয়াযীদের দিকে ফিরে বললেন, “হে ইয়াযীদ, এ সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ রাসূল কি আমার প্রপিতামহ, নাকি তোমার? যদি তুমি বলো যে তোমার প্রপিতামহ, তাহলে গোটা পৃথিবী জানে তুমি মিথ্যা বলছো। আর যদি তুমি বল যে তিনি আমার প্রপিতামহ, তাহলে কেন তুমি আমার পিতাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছো এবং তার মালপত্র লুট করেছো এবং তার নারী-স্বজনদের বন্দী করেছো? এ কথা বলে ইমাম (আ.) নিজের জামার কলার ছিঁড়ে ফেললেন ও কাঁদলেন। এরপর বললেন, আল্লাহর শপথ, এ পৃথিবীর ওপরে আমি ছাড়া কেউ নেই যার প্রপিতামহ হলেন রাসূলুল্লাহ (সা.), কেন এ লোকগুলো আমার পিতাকে জুলুমের মাধ্যমে হত্যা করেছে এবং আমাদেরকে রোমানদের মতো বন্দী করেছে? এরপর বললেন, হে ইয়াযীদ, তুমি এটি করে আবার বলছো যে মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর রাসূল এবং তুমি ক্বিবলার দিকে মুখ ফিরাও, অভিশাপ তোমার ওপর ঐদিন যেদিন আমার প্রপিতামহ এবং পিতা তোমার ওপর ক্রোধান্বিত হবেন।” এ কথা শুনে ইয়াযীদ মুয়াযযিনকে নামাযের ইক্বামাহ দিতে বললো। লোকজনের ভেতর গুঞ্জন উঠলো এবং তাদের ভেতর একটি তোলপাড় শুরু হলো। এরপর একটি দল তার সাথে নামাজ পড়লো এবং অন্যরা পড়লো না এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে চলে গেলো।
তথ্যসূত্র: [মহানবী (সা.)-এর বন্দী পরিবার শীর্ষক বই , সংকলক: মুহাম্মদ ইরফানুল হক]

captcha