IQNA

পানি ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তিতে মুসলমানদের অবদান

0:03 - September 10, 2022
সংবাদ: 3472433
তেহরান (ইকনা): পানি মহান আল্লাহর অমূল্য নিয়ামত। পানির গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে বলা হয় পানির অপর নাম জীবন। পবিত্র কোরআনে এ উক্তিটির সপক্ষে প্রমাণ রয়েছে। ইরশাদ হয়েছে, ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে আকাশ আর জমিন একসঙ্গে সংযুক্ত ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে আলাদা করে দিলাম, আর প্রাণসম্পন্ন সব কিছু পানি থেকে সৃষ্টি করলাম।
তবু কি তারা ঈমান আনবে না?’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৩০)
অর্থাৎ প্রত্যেক প্রাণী সৃজনে পানির অবশ্যই প্রভাব আছে। এসব বস্তু সৃজন, আবিষ্কার ও ক্রমবিকাশে পানির প্রভাব অপরিসীম। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, আমি রাসুল (সা.)-এর কাছে আরজ করলাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমি যখন আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি, তখন আমার অন্তর প্রফুল্ল এবং চক্ষু শীতল হয়। আপনি আমাকে প্রত্যেক বস্তু সৃজন সম্পর্কে তথ্য বলে দিন। জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক বস্তু পানি থেকে সৃজিত হয়েছে। ’ (মুসনাদে আহমাদ : ২/২৯৫)
 
জীবন এবং কৃষিকাজের জন্য অপরিহার্য একটি উপাদান হলো পানি। যে অঞ্চলে এর ব্যবস্থপনা যত উন্নত হবে, সেখানকার কৃষি ও জীবনযাত্রায়ও এর সুফল পরিলক্ষিত হবে। তাই মুসলিম আবিষ্কারকরা এই অঙ্গনেও ব্যাপক গবেষণা চালিয়েছেন।
 
মুসলিমরা সেচব্যবস্থা প্রযুক্তির ক্রমোন্নতিতে অনেক কাজ করেছে। মুসলিমদের প্রকৌশল-অগ্রতির প্রধান কারণ ছিল গণিতে মুসলিম পণ্ডিতদের প্রভূত উন্নয়ন। এই একই কারণে তৎকালের পানি সম্পর্কিত অনুসন্ধান এবং সেচ দেওয়ার যন্ত্রে প্রতিনিয়তই উন্নয়ন ঘটছিল। একাদশ শতাব্দীর পারস্য গণিতবিদ এবং প্রকৌশলী মুহাম্মাদ আল-কারাজি ‘গুপ্ত পানির উৎস’ খোঁজা নিয়েও কথা বলেছিলেন। তিনি এ সময় পানির উৎস খোঁজার কৌশল, পানি আহরণের কৌশল এবং এসব কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন। পানি বাষ্পে পরিণত হয়ে উবে যাওয়া রোধ করতে মুসলিম বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ খুঁড়ত। এই সুড়ঙ্গগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল কানাত। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন সুড়ঙ্গ নির্মাণ হয়েছিল পারস্যে। দিন দিন কৃষি খাতে যত উন্নতি ঘটতে শুরু করে এবং যতই বেশি ফসল ফলানোর চাহিদা বাড়তে থাকে, পানির প্রয়োজনও বাড়তে থাকে। এ চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বহু কানাত নির্মাণ করা হয়। গ্রীষ্মকালে উচ্চ তাপমাত্রার কারণে মধ্যপ্রাচ্যে কানাত খনন একেবারে জরুরি হয়ে পড়েছিল। এরপর স্পেনের কর্ডোভাতে কানাত খনন পদ্ধতি চালু হয় এবং এতে করে শহরে ও গৃহস্থালির কাজে ব্যবহারের জন্য পানি সরবরাহ শুরু হয়। পারস্য রাজ্য ও বর্তমান আফগানিস্তানে হাজারো কুয়া স্থাপন করা হয়েছিল এবং এই কুয়াগুলো কানাত বা সুড়ঙ্গ দ্বারা সংযুক্ত ছিল। মাইলের পর মাইল অবিচ্ছিন্নভাবে পানি সরবরাহের উপযোগী করে এই কানাতগুলোকে বিশেষভাবে তৈরি করা হতো। কোনো কোনো এলাকায় এই কানাত পাথরের ওপর একটি ছোট নদী মনে হলেও ভিন্ন ভূখণ্ডে এটি ভিন্ন রূপ নিত। আলজেরীয় সাহারা ভূখণ্ডে ‘ফোগারাস’ নামক এ রকম একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গের চ্যানেল ছিল। সেখানকার কৃষকরা একটি পানিঘড়ি ব্যবহার করে পানির সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করত।
 
ইরানের বেশ কিছু অঞ্চলে জলবিদ্যুৎ বাঁধ এবং আধুনিক সেচের ব্যবস্থা থাকলেও অনেক কৃষকই বর্তমান সময়েও এই কানাতব্যবস্থা ব্যবহার করে থাকেন। শিরাজের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে এখনো ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ এবং কুয়া থেকে পানি আহরণ করা হয়। এই অঞ্চলগুলোর জলবায়ু এবং পানির স্বল্পতাতে আলোকপাত করলে আমরা দেখতে পাব আধুনিক সময়ের মতোই প্রাচীন যুগেও পানির নিয়ন্ত্রণ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ছিল। সে সময়ের কর্তৃপক্ষও তা নিয়ন্ত্রণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ইরাকে পানি ব্যবস্থাপনার বড় বড় প্রকল্প সরকার দেখাশোনা করত। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ স্থানীয় পানি উত্তোলন যন্ত্রের মাধ্যমেই পানির চাহিদা মেটাত।
 
মিসরবাসীর জীবনের প্রতিটি অংশের সঙ্গে মিশে ছিল নীলনদের পানি। এ নদের পানি ব্যবস্থাপনারও প্রয়োজন ছিল প্রকট। ১৪ শতাব্দীর মিসরীয় ইতিহাসবিদ আল-নুয়াইরি এবং আল-মাকরিজি—দুজনই নীলনদের পানি ব্যবস্থাপনা, বাঁধ নির্মাণ ও জলপথ রক্ষণাবেক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছিলেন। আব্বাসীয় ও মামলুক শাসনামলে সুলতান ও স্থানীয় জমিদাররা বাঁধ পরিচালনাসহ সুড়ঙ্গ খনন এবং পরিষ্কার রাখার পরিচালনার দায়িত্বে থাকতেন। ইরাকের সুলতান নিজে বড় অবকাঠামো পরিচালনা করতেন আর অন্যান্য মানুষ ছোটখাটো অবকাঠামো পরিচালনার দায়িত্ব নিত। অধিকাংশ আমির এবং উচ্চশ্রেণির কর্মকর্তাদেরই এ রকম কাজে প্রধান পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হতো। মামলুকদের অধীনে কাশিফ আল-জুসুর পদবিধারী এক কর্মকর্তাও ছিলেন, যার কাজ থাকত মিসরের প্রতিটি প্রদেশের বাঁধ পর্যবেক্ষণ করা। এ বাঁধগুলোতে ময়লা ফেলা নিষিদ্ধ ছিল। পাশাপাশি পানি আইনের অমান্যকারী এবং যুক্তি-তর্ককারীর আদালতে বিচার করা হতো। কৃষকরা নিজেরাই এসব আদালতের বিচারপতি নির্বাচন করত। এই আদালতের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘দ্য ট্রাইব্যুনাল অব দ্য ওয়াটার্স’ এবং প্রতি বৃহস্পতিবার স্থানীয় প্রধান মসজিদের ফটকের সামনে এ আদালত বসত। দশ শতাব্দী পরেও ভ্যালেন্সিয়াতে এই ট্রাইব্যুনাল বসত, তবে তখন এটি ক্যাথেড্রালের সামনে বসত।
 
১২ শতাব্দীর উদ্ভিদবিজ্ঞানী ইবনে আল-আওয়্যাম তার রচিত ‘দ্য বুক অব অ্যাগ্রিকালচার’ বইয়ে ডিপ সেচ (অল্প ও প্রয়োজনীয় পরিমাণে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা) সম্পর্কে বলেছিলেন, এই পদ্ধতি পানির অপচয় রোধ করত এবং অতিরিক্ত পানি দেওয়া থেকে বিরত রাখত। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে গাছের গোড়ার কাছে পানি ভর্তি পাত্র রাখতেন এবং পাত্রে বেশ কিছু ছোট ছিদ্র করতেন, যাতে করে পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই পদ্ধতিটি বর্তমানে বিশ্বজুড়ে ব্যবহার করা হচ্ছে। মুসলিমরা দক্ষ সিভিল ও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হওয়াতে পানি ব্যবস্থাপনায় তাদের কোনো সমস্যাই হয়নি। পানির উৎস একটি গিরিসংকট হলেও তারা পানি উত্তোলনের জন্য জটিল যন্ত্র এবং পাম্প ব্যবহার করে সব সমস্যার সমাধান করত।
 
 
 
তথ্যঋণ : মুসলিম সভ্যতার ১০০১ আবিষ্কার
 
 
captcha