এ দুটি দলের ঐক্যের কোনো সম্ভাবনাই তিনি দেখতেন না। হজ তাঁকে সেই চিন্তা থেকে সরে আসতে বাধ্য করে। এরপর তিনি শুধু মানুষের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্বেই বিশ্বাসী হয়ে ওঠেননি; বরং হজ থেকে পাওয়া আদর্শের পক্ষে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হন।
যেভাবে বদলে যান ম্যালকম এক্স : ম্যালকম হজ থেকে শেখার জন্য উন্মুখ হয়ে ছিলেন। সত্য অনুধাবনে সদা উদগ্রীব ছিলেন। তাই মক্কায় গিয়ে তাঁর চোখ খুলে যায়। হজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করে তিনি বলেছিলেন, ‘হজের মতো এত উষ্ণ আতিথেয়তা এবং হৃদয়োৎসারিত ভ্রাতৃত্ববোধ আমি কখনো দেখিনি। ইবরাহিম, মুহাম্মদসহ অনেক নবীর স্মৃতিবিজড়িত মক্কার পুণ্য ভূমিতে বর্ণ-বৈষম্যের কোনো স্থান নেই। পৃথিবীর নানা প্রান্তের লাখো হজযাত্রী সেখানে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে নীলচোখা স্বর্ণকেশী থেকে শুরু করে কালো চামড়ার আফ্রিকান—সব বর্ণের মানুষের উপস্থিতি ছিল। ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের অনুশীলন করতে করতেই আমরা একই ইবাদতে মগ্ন ছিলাম। পক্ষান্তরে এসব ক্ষেত্রে আমেরিকা আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে সাদা-কালো কখনো এক কাতারে দাঁড়াতে পারে না।’
আমেরিকার প্রতি বার্তা দিয়ে ম্যালকম বলেছিলেন, ‘আমেরিকাকে ইসলাম বুঝতে হবে। এই ধর্ম সমাজ থেকে বর্ণ-বৈষম্য একদম মুছে দিয়েছে। মুসলিমবিশ্বে সফরকালে, আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গ বিবেচিত হয় এমন বর্ণের অনেক মানুষের সঙ্গে আমি মিলিত হই, কথা বলি এবং এক টেবিলে বসে খাওয়াদাওয়া করি। তবে সাদা চামড়ার অহংবোধ তাদের কল্পনায়ও নেই; ইসলাম তাদের মাথা থেকে তা পুরোপুরি সরিয়ে দিয়েছে। বর্ণ-বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে সব মানুষ একসঙ্গে মিলে এত নিখাঁদ ভ্রাতৃত্ববোধ চর্চা করতে পারে—তা আমি কখনোই ভাবিনি।’
ম্যালকম নিজেকে বদলাতে এবং সত্য আলিঙ্গন করতে উন্মুখ ছিলেন বলেই তিনি পেরেছিলেন। হজ তাঁর মনে বইয়ে দেয় শান্তির সুবাতাস। এক আল্লাহর প্রভুত্বের ছায়ায় বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ তাঁর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। স্রষ্টার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক গভীরতর হয়। এখান থেকেই তিনি সত্যিকারের বিশ্বাস ও ত্যাগের অনুপ্রেরণা লাভ করেন। সর্বোপরি তিনি ইসলাম ও ঈমানের গভীরতর সংজ্ঞার সঙ্গে পরিচিত হন।
হজের শিক্ষা : ম্যালকমের মতো হজের সুফল পেতে হলে আমাদের হজের শিক্ষাগুলো আত্মস্থ করতে হবে। হজের সৌরভে নিজেদের মাতিয়ে রাখতে কয়েকটি শিক্ষা এখানে তুলে ধরছি—
এক. মহান আল্লাহর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক গভীরতর করে হজ। রাসুল (সা.) আমাদের শিখিয়েছেন যে হজের সব আচার-অনুষ্ঠান, এমনকি সব ইবাদত আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে। তাই জিকিরকে আমাদের নিত্য-অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। আর তা সম্ভব শুধু নবীজির দৈনন্দিন পাঠ করা দোয়া ও জিকিরের নিত্য-অনুশীলনের মাধ্যমেই।
দুই. হজে মৃত্যু-চিন্তার সুযোগ মেলে। শরীরে পেঁচানো কাফনের মতো সাদা ইহরাম পরে দৌড়াদৌড়ি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় মৃত্যুর পথে অনন্ত যাত্রার কথা।
তিন. হজ বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ শেখায়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এর অনুশীলন করতে হবে। মসজিদের কাতারে সকল সংকীর্ণতা একপাশে রেখে বিশ্বাস ও মানবতার ভিত্তিতে অপর ভাইকে আলিঙ্গন করে নিতে হবে।
চার. হজ ও জামাতে নামাজ মানে শুধু আল্লাহর দরবারে হাজিরা দেওয়াই নয়; বরং এ দুটি ইবাদতের উদ্দেশ্য হলো সব গোত্র, বর্ণ ও জাতীয়তার মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসা। তাই নিয়মিত মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায়ের প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।
পাঁচ. হজ আমাদের বিশ্বনাগরিক হতে শেখায়; শান্তি ও ঐক্যের মাধ্যমে সুসংহতভাবে বসবাস করার সবক দেয়। তাই অন্যের সঙ্গে মেশার সময় ভ্রাতৃত্ব, ক্ষমা, সহনশীলতা, মমতা ও উদারতার অনুশীলন করা দরকার।
লেখক : উত্তর আমেরিকার বিশিষ্ট ইসলামিক স্কলার এবং সিনিয়র লেকচারার, দ্য ইসলামিক ইনস্টিটিউট অব টরেন্টো, অন্টারিও, কানাডা
অ্যাবাউট ইসলাম ডটনেট থেকে ভাষান্তর করেন ইজাজুল হক