IQNA

মুহম্মদ মুহসিন;

বীর যোদ্ধা তিতুমীর ।। পর্ব-৫

22:58 - October 03, 2020
সংবাদ: 2611578
তেহরান (ইকনা): কুঠুরির ছবি তুলে ফিরে ঐ লোকটিকে আবার জিগ্যেস করলাম ভিতরে ভিতরে ইমাম হোসেনের (রাঃ) স্মরণে নির্মিত ওটি কি? লোকটি বিরক্তির সাথে উত্তর দিলো- ‘কেন? কারবালা’। আমি নাদান বুঝলাম না কিছুই। আমি তো জানি কারবালা হলো ইরাকের এক প্রান্তর, যেখানে কুখ্যাত ইয়াজিদের চক্রান্তে মহানবীর (সঃ) নাতি ইমাম হোসেন সপরিবারে শাহাদাৎ বরণ করেছিলেন।

নারিকেলবেড়িয়ার একটি ভবন কীভাবে কারবালা হয় আমার মাথায় তার কিছুই ঢুকলো না। মাথায় কিছু ঢুকলো না বলেই বোকার মতো ক্ষোভ নিয়ে আবার ঢুকলাম ঐ বেষ্টনীর মধ্যে। আমি ঢুকলাম ঠিকই তবে আমার মাথায় এবারও কিছু ঢোকানোর পেলাম না। তবে ইমাম হোসেন লিখিত ভবনের গায়ে দুটো পোস্টার পেলাম প্যানাফ্লেক্সের। একটিতে ছিল খাজা মঈনুদ্দিন চিশতীর নিম্নরূপ একটি উক্তি :

৯২/৭৮২/১১০
হোসাইনের নামে আমার জীবন উৎসর্গকৃত, আমি কেবল তারই গোলাম যিনি হোসাইনের গোলাম।
—খাজা মঈনুদ্দিন চিশতী
সৌজন্যে : হজরত আলী আকবার (আঃ) এ্যাসেসিয়েশন
পোস্টারটা দেখলাম, কিন্তু ভেবে বুঝে উঠতে পারলাম না কিছুই। কোনো লেখার শুরুতে ৭৮৬ লিখলে তা দিয়ে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ বোঝায়। আরবি বর্ণমালার প্রতি হরফের সংখ্যা মান আছে। বিসমিল্লাহর হরফের সংখ্যামান যোগ করলে সমষ্টি দাঁড়ায় ৭৮৬। সেই ভিত্তিতে ৭৮৬ হলো বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম। কিন্তু ৯২ এবং ১১০ দ্বারা এমন কিছু বোঝানোর কাহিনি আমি কোথাও শুনিনি। বুঝলাম না সে সংখ্যার ভেদ। আবার মঈনউদ্দীন চিশতীকে চিশতীয়া তরিকার প্রবর্তক এক সুন্নী মুসলমান হিসেবে জানতাম। তিনি নিজেকে হোসাইনের গোলাম মর্মে শিয়া আকিদার স্বীকৃতি দিয়েছেন এমনটাও কোথাও শুনিনি। এইসব মাথা ঘুরানো বিষয়াদি দেখে মনে হচ্ছিলো এখানে ঘুরে ঘুরে মূর্খতা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। বেরিয়ে পড়ি। তবে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দ্বিতীয় পোস্টারটির কাছে গেলাম ছবি তুলতে। এই পোস্টারটিতে অবশ্য মাথা আর নতুন করে ঘুরলো না। এটিতে শিরোনাম দেয়া আছে ‘কারবালার ৭২ শহীদের নাম’। নিচে অবশ্য ৬৭ জনের নাম আছে। বাকী ৫ জনের নাম নেই কেন? নাই থাকতে পারে। এতে আর মাথা ঘোরার কী আছে?
এমন শক্তিশালী সান্ত্বনা নিয়ে বের হয়ে এলাম তিতুমীরের নারিকেলবেড়িয়া বাঁশের কেল্লার স্মৃতি বিজড়িত ভূমির বেষ্টনী থেকে। বের হওয়ার সময় বেষ্টনীর মূল ফটকের পাশে দেখলাম একটি কাগজের পোস্টার। এই পোস্টারের লেখাটি ছিল নিম্নরূপ :
৯২ (৭৮৬) ১১০
বিষাদময় শাহাদাৎ দিবস স্মরণে:
পরিচালনাঃ আল-মাহদী (আঃ) ফাউন্ডেশন
স্থান : কেওটাশাহ মসজিদ হইতে নারিকেলবেড়িয়া কারবালা
তারিখ : ইং ৫মার্চ ২০১৭, বাং ২১ শে ফাল্গুন ১৪২৩, রবিবার
সময় : সকাল ১২ টা হইতে প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত

উল্লিখিত নির্ঘণ্ট অনুসারে সর্বকালীন বিশ্বনারীকুল সম্রাজ্ঞী, নির্যাতিতা হযরত ফাতিমা যাহরা (সাঃ আঃ) এর ১৪২৭ তম শোকবহ শাহাদাৎ দিবস পালনে এক বিশেষ শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইয়াছে।

উক্ত অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি একান্ত কাম্য।

আহ্বায়ক
আল-মাহদী (আঃ) ফাউন্ডেশন
হেড অফিস- মন্দ্রা, জেলা- উত্তর ২৪ পরগনা

ভিতরে বেষ্টনীর মধ্যে মাথা বেশিই ঘোরার কথা। এবার বাইরে আলো বাতাসে দাঁড়িয়ে এই পোস্টারটির অনেক অসংলগ্ন তথ্যও যেন মাথাটাকে অতোটা ঘুরালো না। বরং এই পোস্টারটি থেকে বুঝতে পারলাম এখানকার শিয়ারা বাংলাদেশের মতো শুধু ইমাম হোসেনের শাহাদাৎ নিয়েই শোক করে না। এখানে শোক হযরত আলীর পরিবারের অনেককে ঘিরেই অনুষ্ঠিত হয়। এরা কি তাজিয়া না বলে বাংলায় সরাসরি শোক অনুষ্ঠান বলে? আর এরা বাংলাদেশের শিয়া তো বটেই এমনকি সুন্নীদের চেয়েও উদার। ‘ধর্ম যার যার, উৎসব সবার’- মর্মে যে শ্লোগান বাংলাদেশের প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীরা বলে থাকেন এখানে শিয়ারা খোদ তাদের ধর্মীয় আহ্বানপত্রেই সেই কথা স্পষ্টাক্ষরে উদারভাবে ঘোষণা করে দিয়েছে- ‘উক্ত অনুষ্ঠানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সংবেদনশীল ও সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি একান্ত কাম্য’। পোস্টারটি থেকে আরো বুঝলাম গোসল করতে থাকা ভদ্রলোক আব্দুল কাদের বিরক্তিতে হোক আর স্বাভাবিক মেজাজে হোক ঠিক কথাই বলেছেন, এ স্থানের নাম সত্যিই কারবালা- নারিকেলবেড়িয়া কারবালা।
আব্দুল কাদের ভদ্রলোক তার গোসল ও ধৌতকার্য তখনো চালিয়ে যাচ্ছিলো। গোসল করতে থাকা টিউবওয়েলটির পিছনেই একটি মসজিদ। ১০০ গজের মধ্যে পূর্ব দিকে আরো একটি মসজিদ। সাহস করে আব্দুল কাদের সাহেবের কাছে জানতে চাইলাম- ‘এত কাছাকাছি দুটি মসজিদ কেন?’ আব্দুল কাদেরের উত্তরে আবারও বিরক্তি কিংবা বিস্ময়। ‘ওটাতো শিয়া মসজিদ, আর এটা হলো সুন্নী মসজিদ’। ‘ও আচ্ছা! এই সুন্নী মসজিদওয়ালা বাড়িটার নাম কী’? ‘বিশ্বাস বাড়ি’।
বিশ্বাসবাড়ি কথাটার মধ্য দিয়ে আমার ইতিহাস পাঠ হঠাৎ যেন আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠলো। এটিই তাহলে সেই মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাসের বাড়ি? মুঈজ উদ্দীন বিশ্বাস ছিলেন নারিকেলবেড়িয়া গ্রামের সেই ব্যক্তি যিনি সরফরাজপুরে তিতুমীরের প্রথম মসজিদ কৃষ্ণদেব রায় কর্তৃক ভস্মীতূত হওয়ার পরে তিতুমীরকে তাঁর তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার সংস্কার ও জমিদার এবং ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের কার্যক্রমের সদরদপ্তর স্থাপনের জন্য নিজ বাড়িতে জায়গা দিয়েছিলেন। তিতুমীরকে তাঁর ধর্মীয় সংস্কার ও ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামের সমর্থনে তখন বাড়িতে স্থান দেয়া ছিল অনেক ঝুঁকির বিষয়।
বিশ্বাস বাড়ির এই ইতিহাস যখন মনেই পড়লো সে সুযোগে তিতুমীরের ইতিহাসের একটি প্রাথমিক ধারণা এখানে টেনেটুনে হলেও হাজির করা যায়। একথা মোটামুটি অনুমান থেকেই বলা যায় যে, তিতুমীর ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন যথেষ্ট ডানপিটে। সাহসী কিছু ঘটিয়ে ফেলার সম্ভাবনায় তিনি ছিলেন সকলের জন্যই ভয়ের এক ব্যক্তি। ছেলেবেলায় গ্রামীণ মাদ্রাসায় পড়াশোনাকালেই তিনি পার্শ্ববর্তী এক ব্যায়ামাগারের প্রতি আকৃষ্ট হন। সেখানে অনুশীলনের মাধ্যমে একজন কুস্তিগীর হিসেবে তিনি প্রসিদ্ধি লাভ করেন। ১৮১৫ সালে তিনি কোলকাতায় একজন পেশাদার কুস্তিগীর হিসেবে বাস করতেন। পরে নদীয়ার এক জমিদারের অধীনে একজন লাঠিয়াল হিসেবে চাকুরি গ্রহণ করেন। লাঠিয়ালের চাকুরিতে থাকাকালে একবার এক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় তিনি ধৃত হন এবং বিচারে তিনি কিছুকাল জেলে আবদ্ধ থাকেন। জীবনের এই পর্যন্ত তিতুমীর ছিলেন একজন লাঠিয়াল মাত্র।
তাঁর তিতুমীর হয়ে ওঠার টার্নিং পয়েন্টটি ছিল তৎকালীন মোগল সম্রাটের দরবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তির সাথে পরিচিত হয়ে ওঠার ঘটনা। অনুমান করা যায় যে, কুস্তিগীর হিসেবে খ্যাতিতেই তিতুমীরের নামটি পৌঁছায় মোগল রাজদরবারের প্রভাবশালী ব্যক্তি মির্জা গোলাম আম্বিয়ার দরবারে। মির্জা গোলাম আম্বিয়া তখন ছিলেন কোলকাতার মির্জাপুর এলাকার জমিদার। এ ঘটনা ১৮২০-২২ সালের দিকের। মোগল দরবারের এই প্রভাবশালী লোকটির আশীর্বাদে তাঁর সাথে তিতুমীর ১৮২৩ সালে মক্কায় হজ্ব করতে যাওয়ার সুযোগ পান। হজ্জব্রত শেষে তিতুমীর মক্কায় আরো চার বছর অবস্থান করেন। চার বছর মক্কা অবস্থানকালেই মূলত তাঁর জীবনে ঘটলো সেই যুগান্তকারী ঘটনা যা তাঁকে পরিণত করেছিল আমাদের জানা তিতুমীরে। ঘটনাটি ছিল শহীদে বালাকোট সৈয়দ আহমদের বেরেলভির শিষ্যত্ব লাভ।
ফলত তিতুমীরের পরবর্তী জীবন নিয়ে কথা বলার জন্য বলে নেয়া দরকার কে ছিলেন এই সৈয়দ আহমদ বেরেলভি। সৈয়দ আহমদ ছিলেন উত্তরপ্রদেশের রায়বেরেলির সন্তান। বয়সে তিতুমীরের চেয়ে চার বছরের ছোট। অর্থাৎ ১৭৮৬ সালে জন্ম। সৈয়দ আহমদের পিতার নাম ছিল সৈয়দ মুহাম্মদ ইরফান এবং পিতামহ ছিলেন সৈয়দ ইলমুল্লাহ। সৈয়দ আহমদ ছিলেন ইমাম হাসানের বংশের অধস্তন ৩৪তম পুরুষ। তৎকালীন ভারতীয় মুসলমানদেরকে জাতীয়ভাবে উজ্জীবিত করনের প্রয়াসে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভীর তরিকায়ে মুহাম্মাদীয়ার একজন অনুসারী। শাহ ওয়ালীউল্লাহর প্রসঙ্গটি বুঝতে এবার আরও একটু পিছনে যাওয়া দরকার।
(চলবে)...
সূত্র: banglatribune

captcha