IQNA

মুহম্মদ মুহসিন;

বীর যোদ্ধা তিতুমীর ।। পর্ব-৯

14:36 - November 06, 2020
সংবাদ: 2611767
তেহরান (ইকনা): ‘একদিন বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। এক ভদ্রলোকের হাতে ইংরেজি বই দেখে তাঁকে সুলতানদের প্রাচীন প্রাসাদ তোপকাপির পথ জিগ্যেস করলাম। ভদ্রলোক একটুও দ্বিধা না করে বললেন, “সে হবে’খন। এখন চল, আমার সঙ্গে খাবে। আমার মা খুব ভাল রাঁধেন।”

এরকম একটা ঘটনা ইংল্যান্ডে তো নয়ই, ইউরোপে কোথাও হওয়া সম্ভব বলে মনে করি না। আমাদের প্রাচ্য সভ্যতা জিন্দাবাদ (২৪৮)। লেখক এই বাঙালি মহব্বতের আরেক নজির সম্পর্কে লিখছেন তুরস্ক থেকেই। ‘জাহাজের টিকিট কাটতে ঠিক জানালায় দাঁড়িয়েছি কি না বোঝবার উপায় নেই। আবারও চোখে পড়ল এক যুবকের হাতে ইংরেজি বই। সে আমার সামনেই দাঁড়িয়ে। জিগ্যেস করলাম, ঠিক জানালায় এসেছি তো, হায়দারপাশার টিকিট কাটার জন্য? সে বলল, “হ্যাঁ, কোথায় যাবে?” বললাম টরাস এক্সপ্রেস ধরব। দু মিনিট পর সে হায়দারপাশার টিকিট এনে আমাকে দিল। দাম দিতে গেছি। “আরে নানা! ছি ছি!” (২৪৯)।’


ঠিক এমন মহব্বত পেলাম মদত সাহেবের কাছে। কোথাকার কার সাথে হঠাৎ পরিচয় রাস্তায় আর তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া বৌয়ের হাতের মুড়ি-মাখা খাওয়াতে। সকালে এই পথে লম্বা করে যাদেরকে সালাম দিচ্ছিলাম কিন্তু মহব্বতের সাড়াটি পাচ্ছিলাম না তাদের মহব্বত মদত সাহেবের চেয়ে কম ছিল মনে করাটা হয়তো ঠিক না। তারা বুকের মহব্বতটা হয়তো বার করে হাতে এনে দেখাতে পারছিলো না শুধু এই কারণে যে সভ্যতার অভিশাপে তারা মহব্বত দিয়ে অনেক ঠকেছে। ঠকে ঠকে এমন হয়েছে যে এখন আচমকা কোথাও মহব্বত দেখাতে গেলে আস্ত বুকটাই ঠক করে ওঠে এবং মহব্বতটা দমে যায়। কিন্তু সেই ঠকঠকা সন্দেহটা কোনোভাবে সরানো গেলেই দেখা যায় এই মাটির কেউই মহব্বতে তুরস্কের ঐ লোকগুলোর চেয়ে কম না যাদের কথা তপন রায়চৌধুরী উদাহরণ হিসেবে জানিয়েছেন সারা দুনিয়াকে।
মদত সাহেবের সাথে চললাম তাঁর বাড়ির দিকে। তাঁর বৌয়ের হাতের মুড়িমাখা তো খেতেই হবে। এরপর দুপুরে লাঞ্চ করে বিশ্রাম নিয়ে বিকালে কোলকাতা রওয়ানা হওয়া যাবে, প্রয়োজনে তিনি নিজে গিয়ে মছলন্দপুর থেকে আমাকে ট্রেনে তুলে দিবেন। এমন আন্তরিক সব শব্দের উচ্চারণের সাথে চলছি তাঁর বাড়ির দিকে। হেঁটে হেঁটে সাইকেল হাতে টেনে তিনি আমাকে নিয়ে চললেন তাঁর বাড়ির দিকে। আর পথে দিতে থাকলেন নারিকেলবেড়িয়া কারবালায় আমার তৈরী হওয়া খটকাসমূহের সমাধান। যে সমাধান তিনি দিতে পারলেন না তার মধ্যে বিশেষ একটি হলো- কারবালা কেন বাঁশের কেল্লার চত্বরেই করা হলো তার উত্তর তিনি দিতে পারলেন না।
মদত সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়িতে। বাড়িটি একেবারে রাস্তার সাথে সংলগ্ন। একতলা একটি ছোট ভবন। একটি পড়ার ঘরও রয়েছে বাসায়। কিছুক্ষণেই চলে আসলো তাঁর বৌয়ের হাতের মুড়িমাখা। এরপর তাঁর সদ্য ইরাক ও ইরান সফর থেকে আনা খেজুর। গল্প করলেন ইরাকের কারবালার এবং ইরানের বিভিন্ন ঐতিহাসিক ডকুমেন্টের। গর্বের সাথে বললেন ইরানের সফরে তাঁর সাথে বাংলাদেশিও দুজন ছিলেন এবং তাঁর সেখানে এই সফরের জন্য লেগেছে মাত্র ৩০০০০ টাকা, অথচ বাংলাদেশি ভাইদের নাকি লেগেছে প্রত্যেকের দেড় লক্ষ টাকার উপরে। তাঁর বিশ্বাস এর কারণ হলো ভারতের সাথে ইরানের সম্পর্ক বাংলাদেশের সাথে ইরানের সম্পর্কের চেয়ে অনেক ভালো। তিনি শুকরিয়ার সাথে বললেন ভারত সরকার বিশেষ করে শিয়া মুসলিমগণকে আন্তরিকভাবে নিরাপত্তা প্রদান করে এবং বিভিন্ন রকম সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তিনি খুব আনন্দিত যে তাঁর জন্ম বাংলাদেশ বা পাকিস্তানে হয়নি।
এসব কথাবার্তায় আমার যে খুব লাভ হচ্ছে না অর্থাৎ আমি যাঁর সম্পর্কে দেখতে ও জানতে এসেছি সেই তিতুমীর সম্পর্কে তিনি আমাকে যে কিছুই বলতে পারছেন না- হঠাৎই মনে হলো তিনি সে বিষয়ে সচেতন। কারণ টের পেলাম ইতোমধ্যে তিনি মনে মনে ঠিক করেছেন রেখেছেন যে আমাকে তিনি হায়দারপুর গ্রামে পাঠানোর জন্য ব্যবস্থা করবেন যেখানে তিতুমীরের জন্মভিটায় এখনো তাঁর অধস্তন প্রজন্মের লোকেরা বাস করছেন। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে মদত সাহেব হায়দারপুর গ্রামে বসবাসরত তিতুমীরের পঞ্চম অধস্তন পুরুষ অপর এক মদত সাহেবকে ফোন দিলেন। ফোন দিয়ে বললেন যে, বাংলাদেশের এক প্রফেসরকে তিনি তাঁর কাছে পাঠাচ্ছেন এবং অনুরোধ করলেন যাতে তিনি বাংলাদেশি ভদ্রলোককে অর্থাৎ আমাকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করেন এবং যতটুকু সম্ভব তথ্য দিয়ে যেন সাহায্য করেন। এই ব্যবস্থা করার আগে অবশ্য তিনি বার বার অনুরোধ করছিলেন যাতে আমি বিকালে কোলকাতায় রওয়ানা হই, তাহলে তাঁর বাসায় লাঞ্চ করিয়ে তিনি আমাকে তাঁর নিজের মোটরবাইকে হায়দারপুর পৌঁছে দিবেন। ঐ মুহূর্তে তিনি হায়দারপুর যেতে পারছিলেন না কারণ মোবাল্লেগ হিসেবে দুপুরে জোহরের নামাজের পরে তার পেশাগত কাজ রয়েছে। আমি লাঞ্চ পর্যন্ত থাকায় কোনোভাবে রাজি না হওয়ায় মদত সাহেব তার মোটরবাইকটি বের করলেন যাতে তিনি আমাকে একটি টেম্পোস্ট্যান্ডের মতো জায়গা পর্যন্ত এগিয়ে দিবেন ঠিক করেছেন। সেখান থেকে তিনি আমাকে হায়দাপুরের কোনো মাহিন্দ্র অটোতে বা ম্যাজিক গাড়িতে তুলে দিবেন।
হায়দারপুরের নারিকেলবেড়িয়া থেকে ৭-৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। মদত সাহেব আমাকে পিছনে বসিয়ে বললেন তিনি আমাকে যে গাড়িতে তুলে দিবেন সেটি থেকে নামতে হবে সৈয়দপুরের মোড়ে। সেখান থেকে গ্রাম্য মেঠোপথ ধরে লোকজনকে জিগ্যেস করেই ১০-১৫ মিনিট হেঁটে তিতুমীরের পৈতৃক বাড়ি পৌঁছে যাওয়া যাবে। মদত সাহেব তার জোহর নামাজের সময়ের প্রোগ্রামের কারণে আমাকে পুরো হায়দারপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছেন না- সে আমি জানি। তারপর আবার তিনি একটু খুসখুসে কাশিতেও ভুগছিলেন। মোটরবাইকে বাতাস লেগে সে খুসখুসি আরো বেড়ে যাচ্ছিল। একটি সর্দি জ্বর থেকে তিনি কেবল সেরে উঠেছেন। পুরো ভালো হননি। এর মধ্যেও তিনি আমাকে নিজ মোটর সাইকেলে যে হায়দারপুর পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারছেন না এর জন্য বার বার দুঃখ প্রকাশ করছেন। তিনি দুঃখ প্রকাশ করছিলেন আর আমি লজ্জা পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, আমি তাকে উৎপাত করছি অথচ তিনি কষ্ট পাচ্ছেন কেন অধিকতর উৎপাত তিনি কবুল করে নিতে পারছেন না সেই অক্ষমতাবোধ থেকে। কী সেই শক্তি যার বলে কোনোদিন না দেখা একজন মানুষ আরেকজন মানুষের জন্য এমন আপন হয়ে উঠতে পারে? ইহাই সেই বস্তু সেই হিন্দুস্তানী মৌলবীর বর্ণনায় যার নাম মুহাব্বত।
মোবাল্লেগ মদত আলী সাহেবের এই আন্তরিকতা, পরোপকারব্রত, মুহাব্বত, নিজের মোবাল্লেগি দায়িত্বের প্রতি নিষ্ঠা ইত্যাদি দেখে আমার মনে পড়লো সকাল বেলার স্কুলপড়ুয়া মেয়েটির কথা। ‘তিতুমীর কে ছিলেন’-এর উত্তরে মেয়েটি বলেছিল- ‘কোনো বড় মোবাল্লেগ টোবাল্লেগ হবে হয়তো’। ঐ উত্তরে আমি যারপরনাই হতাশ বোধ করেছিলাম এই ভেবে যে, তিতুমীর সম্পর্কে তাঁর বাড়ির পাশের ছেলেমেয়েরাও কিছুই জানছে না। কিন্তু মদত আলী সাহেবের মধ্য দিয়ে মোবাল্লেগের যে পরিচয় আমি পেলাম তাতে মনে হচ্ছিলো মেয়েটি খারাপ বলেনি। তিতুমীর তো এমন একজন মোবাল্লেগই ছিলেন, শুধু মোবাল্লেগ হিসেবে তাঁর স্তরটা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিকভাবে একটু বড় ছিল এই যা।
মদত সাহেব আমাকে যে-টেম্পোস্ট্যান্ড পর্যন্ত পৌঁছে দেয়ার চিন্তা করেছেন সেখানে আমরা পৌঁছে গেছি। দুজনেই অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি। কোন অটোরিক্সা কিংবা কোনো তিন চাকার মাহিন্দ্র গাড়ি কিংবা কোনো ম্যাজিক গাড়ি- কিছুরই দেখা মিলছে না। মদত সাহেব যে করেই হোক আমাকে মটর সাইকেলেই পৌঁছে দিয়ে আসবেন এমন প্রস্তুতি নিচ্ছেন এমন সময় একটি তিন চাকার মাহিন্দ্র গাড়ি দেখা গেল। সেটি থামানো হলো। ‘ভিতরে সিট নেই তো কী হয়েছে’ বলে উঠে গিয়ে আমি এমন উৎসাহে মাহিন্দ্রের পিছনের পাদানির উপর দাঁড়ালাম যেন মনে হচ্ছিলো আমি মাহিন্দ্রতে ভিতরে সিটে বসে যাওয়ার চেয়ে ঝুলে যেতেই বেশি সচ্ছন্দ বোধ করি। এই অভিনয়টুকু করলাম যাতে মদত আলী সাহেব ভাবতে পারেন যে তিনি আমাকে হায়দারপুরে পৌঁছার জন্য সন্তোষজনক ব্যবস্থা করে দিয়ে তবেই বাসায় ফিরেছেন।
সৈয়দপুর অতদূর তা আমি বুঝতে পারিনি। মনে হচ্ছিল ৮ কিলোমিটার যেতে ৮ ঘন্টা লেগে যাচ্ছে। এমন মনে হওয়ার পিছনে ছিল যাত্রী হিসেবে ঐ মাহিন্দ্রের মধ্যকার অভাবনীয় গাদাগাদির অস্বস্তি। একই মাহিন্দ্র আমাদের দেশে তথা আমাদের বরিশালেও চলে। আমাদের এখানে ঐ সাইজের মাহিন্দ্রতে স্বাভাবিক আসন সংখ্যা ড্রাইভার সহ ৯ জন। সামনে ড্রাইভারসহ ৩ জন, তার পিছনে মূল আসনের বেঞ্চিতে ৪ জন এবং পিছনে মালামাল উঠানোর জায়গায় দুটো আলাদা টুলে দুই পার্শ্বে ১ জন করে মোট দুই জন। নারিকেলবোড়িয়া থেকে হায়দারপুরের ঐ মাহিন্দ্রতে যে কয়জন বসানো হচ্ছিলো তা দেখে মনে হচ্ছিল ম্যাজিক তো ম্যাজিক গাড়িতে নেই সব ম্যাজিক দেখি এই মাহিন্দ্রতে। আমি যে মাহিন্দ্রে চড়লাম সেটি সামনের দুইশ গজ পার না হতে দুইবার থামলো এবং আরো তিনজন মহিলা যাত্রী উঠলো। সবাই দাঁড়ালো আমার সাথেই পা-দানিতে এবং মাহিন্দ্রের পাদানিতের চার জন দাঁড়ালে যে পরিমাণ গাদাগাদি হয় সেই পরিমাণ গাদাগাদি ও ঘেঁষাঘেঁষিতে। আমার পূর্ববঙ্গীয় পুরুষ-শরীরটিকে পাবলিক পরিবহণে পার্শ্বযাত্রী একজন নারীর শরীর থেকে যতটুকু দূরত্ব বজায় রেখে বসার আদব এতদিন বসে শিখেছি তা এক ধাক্কায় জলাঞ্জলি। এখানকার আদব অনুযায়ী বরং চেষ্টা হলো যতখানি গায়ে মিশে দাঁড়ানো যায় যাতে গায়ের চাপে হলেও সকল যাত্রী বাহনটার সাথে আটকে থাকে, ছিটকে পড়তে না হয়। আমার এই আদব রপ্ত হচ্ছে না দেখে বরং অন্যদের অস্বস্তি লাগছিল। ভাবখানা এ রকম যে, এই চিড়িয়া আবার কোন মুল্লুকের।
সামনের আরো দুয়েকটা স্টপেজ পার হতে ভিতর থেকে দু-চারজন নেমে যাওয়ায় আমার ভিতরে একটা সিট অর্জনের সৌভাগ্য হলো। এতক্ষণ বাহিরে অন্তত শ্বাস করার বাতাসটা পাচ্ছিলাম, এবারে ভিতরে গিয়ে দেখি শ্বাসের বাতাসটুকুর জন্য নাকে নাকে কাড়াকাড়ি। তা-ও ভিতরে ঢুকতে পারার মধ্য দিয়ে সৌভাগ্য হলো মোট যাত্রীসংখ্যাটা একবার গুণে দেখার। সামনে ড্রাইভারের দুই পাশে ২ জন করে মোট ৫ জন। তার মধ্যে ২ জন মহিলা, ৩ জন পুরুষ। ড্রাইভারটি অবশ্য পুরুষ। তারপরে মূল আসনে ৪ জন কারণ এই আসনের ক্ষেত্রে বেঞ্চিটার দুই পাশ সামনেরটার মতো খোলা নয়, আটকানো। দুইপাশ খোলা থাকলে এখানে আরো ২ জন ঝোলানোর ব্যবস্থা থাকতো। তারপর পিছনে যেখানে আমাদের মাহিন্দ্রগুলোয় দুই পাশে দুটো টুলে ১ জন করে ২ জন মাত্র বসানো হয়, সেখানটায় দু পাশে ২ জন করে ৪ জন এবং প্রস্থ বরাবর মুখোমুখি ১ জন করে ২ জন অর্থাৎ মোট ৬ জন বসানো। আর পিছনের পাদানিতে ঝোলানো ৩ বা ৪ জন। একটি তিন চাকার মাহিন্দ্রতে ৫+৪+৬+৪ = ১৯ জন মনুষ্য জাতীয় যাত্রী এভাবে চলছিল গন্তব্যের দিকে। এমন চলায় এই গন্তব্য যে যে-কোনো মুহূর্তে চূড়ান্ত গন্তব্য হয়ে যেতে পারে এমন ভাবনা যাত্রী-ড্রাইভার কেউই ঘুণাক্ষরেও করছে না। আমিও সেইসব ভাবনা না করে বরং দেখছি যাত্রাপথে পুরুষ-নারী ভেদ থেকে এই মানুষগুলো কতদূর এগিয়ে গেছে।
সামনে যে-চারজন যাত্রী তাদের মধ্যে ড্রাইভারের বামপাশের জন চেহারাসুরতে একজন মৌলবি এবং ড্রাইভারের ডানপাশের জন মাঝবয়সী মহিলা। দেখা যাচ্ছে ড্রাইভার বসে আছে ঠিক মৌলবির এক পা আর মহিলার এক পায়ের উপরে। স্বাভাবিকভাবেই সামনের এটুকু বেঞ্চিতে চারজন যাত্রী বসলে ড্রাইভারের জন্য তো জায়গা থাকার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু এ নিয়ে মৌলবির বা মহিলার কারো কোনো ভাবান্তর নেই। এমনকি ভাবান্তর নেই ড্রাইভারের নিজেরও। পিছনের খালি জায়গাটুকুতে যেখানে ৬ জন বসেছে সেখানেও অবস্থা একই। তবে কারো বসা নিয়ে অপরের কোনো কমপ্লেইন নেই। ব্যাপারটি আমার কাছে আরো ইন্টারেস্টিং মনে হলো যখন তাদের পারস্পরিক কথাবার্তা থেকে বুঝতে পারলাম যে এরা পুরুষ-মহিলা সবাই কিংবা প্রায় সবাই-ই ধর্মে মুসলমান।
ভারতে এই দৃশ্য গ্রামের কম যানবাহনের পথগুলোয় যেমন সত্য তেমনই সত্য শহরের যানবাহনবহুল এলাকাতেও। এই ঘটনার দুইদিন আগে আমি কোলাকাতায় রাজাবাজার সাইন্স কলেজ থেকে কলেজ স্ট্রিট গিয়েছিলাম প্রায় এমনই এক তিন চাকার অটোতে। সেখানে আমার সিটটি হয়েছিল ড্রাইভারের বামপাশে একজনের পরে। আমার ডানপাশে আমার আগে-বসা জিন্স-টিশার্ট পরিহিত যুব বয়সের যাত্রীটি এমনভাবে বসেছিল যে, বাহনটার মধ্যে নিজেকে কোনোভাবে ধরে রাখার প্রয়োজনে আমাকে বসতে হয়েছিল অনেকটা আগে বসা সেই যাত্রীটির কোলে। যুব বয়সের সেই যাত্রীটি পথে নামলো আমার আগে। নামার সময় ড্রাইভারের সাথে ভাড়া বিষয়ক কথায় তার কণ্ঠ শুনে বুঝলাম আমি এতক্ষণ যার প্রায় কোলে বসে ছিলাম সে কোনা যুবক ছিল না, ছিল একজন যুবতী।
যাক এই আগড়োম-বাগড়োম কথা আর বাড়াচ্ছি না। ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট এই মহান ত্রিচক্রযানে পার করার পরে পাশের এক যাত্রী ও ড্রাইভার উভয়ের ডাক থেকে বুঝলাম আমি আমার গন্তব্য সৈয়দপুরে পৌঁছে গেছি। নামলাম সেই মহান মাহিন্দ্র থেকে। যেখানে নামলাম সেখানেই এক দোকানে জিগ্যেস করলাম- সৈয়দ মদত আলী সাহেবের বাড়ি যাব কীভাবে? লোকটি বললেন ঐ বাড়িতে যাওয়ার আসল রাস্তা পিছনে ফেলে এসেছি। তবে যেখানে নেমেছি সেখান থেকেও যাওয়া যাবে, রাস্তা দিয়ে নয়, মাঠ বা বরিশালের ভাষায় যাকে বলে ‘কোলা’ সেই কোলার মধ্য দিয়ে। একটি গ্রাম্য বাড়ির বাঁশবাগানের পাশ দিয়ে নামলাম কোলায়। কৃষাণদের কাছ থেকে পথ জেনে শেষ পর্যন্ত মদত আলী সাহেবের বাড়ি ঢুকলাম বাড়ির পিছন দিক দিয়ে। পিছন দিক দিয়ে হলেও যে-দীর্ঘ আকারের পুকুরের পাশ দিয়ে যেতে হচ্ছিলো সেটি দেখে একটা সৈয়দ বাড়ী, সৈয়দ বাড়ী ভাব সেখান থেকেই অনুভব হচ্ছিলো।
মদত আলী সাহেবের উঠানের সামনে পঞ্চায়েতের পানি সরবরাহ কলে এক মাঝবয়সী মহিলা হাঁড়ি-পাতিল পরিস্কার করছিলেন। পরে বুঝলাম তিনি মদত আলী সাহেবের পুত্রবধূ ছিলেন। সালাম দিয়ে তার কাছেই জানতে চাইলাম মদত সাহেবের ঘর কোনটি। একটি পরিচ্ছন্ন একতলা ভবনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। গিয়ে ঢুকলাম সরাসরি মদত আলী সাহেব যে-রুমে বসে আছেন সেখানে। ব্যান্ডেজ-করা পা নিয়ে তিনি খাটে বসে আছেন। চেহারা, উচ্চতা, শারীরিক কাঠামো সব দেখে নিমেষেই নিশ্চিত হলাম যে আমি ঠিক জায়গায়ই এসেছি। তিতুমীরের বীরত্বের ছাপ এত প্রজন্মের পরেও এদের চেহারায় লেগে আছে।
কিন্তু তিতুমীরের বীরত্বের ছাপ চেহারায় নিয়ে এবং তার চারিত্রিক দৃঢ়তা শারীরিক কাঠামোতে ধারণ করে লাভ কী হলো? পেশাগত কাজ রূপে তিনি এসব কী করেছেন? তিনি তাবিজ লিখছেন। পাশে বসা গ্রাম্য দারিদ্র্যক্লিষ্ট চেহারার লোকটি পনেরো-বিশ কিলোমিটার দূর থেকে তার কাছে এসেছে তাবিজ নিতে। আমাকে বসিয়ে রেখে তিতুমীরের রক্তবাহী মদত আলী সাহেব সেই লোকটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোন তাবিজটি হাতে বা গলায় কোথায় বাঁধতে হবে, কোন তাবিজটি ভিজিয়ে পানি খেতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। গ্রামের অশিক্ষিত খেটে খাওয়া মানুষদেরকে অভূতপূর্ব এক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে তাদের নিয়ে লাঠিসোটা বর্শা-বল্লম হাতে যে মানুষটি স্বাধীনতার স্বপ্নে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিশ্বজয়ী ইংরেজ শক্তির কামানের সামনে, তাঁর রক্তবাহী ৫ম অধস্তন পুরুষ সৈয়ত মদত আলী শৌর্য-বীর্য-জ্ঞানের সব হারিয়ে এখন শক্তি খুঁজছেন অবৈজ্ঞানিক কুসংস্কারে। অথচ তিতুমীর তার অনুসারীদের নিয়ে তীরবল্লম ইট-বেল জাতীয় লোকজ প্রযুক্তিগত অস্ত্রশস্ত্রকে দাঁড় করিয়ে ছিলেন এমন উচ্চতায় যে সেই লোকজ প্রযুক্তির শক্তির সামনে বৃটিশ পুলিশ ও সৈন্য সমন্বিত তিনটি আক্রমণ প্রতিহত হয়েছিল অভাবনীয় সাফল্যে।
মক্কা-ফেরত তিতুমীর অবশ্য মারামারি বা ঝগড়াঝাটির লোক ছিলেন না, ছিলেন শান্তিপ্রিয়। তিতুমীর বিষয়ক তথ্যাদির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উৎস ব্রিটিশ ভারতীয় সিভিল সার্জেন্ট আই আর কোলডিনের রিপোর্টেও তাঁকে শান্তিপ্রিয় লোক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। মক্কা থেকে এসে ১৮২৭ সালের দিকে তিনি সৈয়দ আহমদ রেরেলভির অনুসারে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। ধর্ম বিষয়ে তাঁর প্রচারিত বিশেষ কয়েকটি মতবাদের মধ্যে অন্যতম ছিল ফাতেহা, ওরস, মহররম ও মিলাদ-কেয়াম করা যাবে না। এই মতবাদটি মুসলমানদের একটি বড় অংশের অপছন্দের ছিল এবং তারাই মূলত প্রথম হিন্দু জমিদারদের নিকট তিতুমীর ও তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে গোলযোগের অভিযোগ করে। জমিদাররা অভিযোগটি গুরুত্বের সাথে গ্রহণ করে কারণ রায়তরা কোনোরকম দলবদ্ধ হোক এটি জমিদাররা কোনোভাবেই চাইতো না। ফলে যে সকল জমিদার তিতুমীরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন তারা হলেন : ১) তারাগোনিয়ার জমিদার রামনারায়ন নাগ, ২) নাগরপুরের জমিদার গৌরপ্রসাদ চৌধুরী, ৩) পুঁড়া বা পূর্ণার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়, ৪) সরফরাজপুরের জমিদার কালী প্রসন্ন মুখোপাধ্যায়, ৫) গোবরার জমিদার দেবনাথ রায় প্রমুখ। বিশেষ করে রাম নারায়ন নাগ এবং গৌরপ্রসাদ রায় চৌধুরী তিতুমীরের অনুসারীদের ওপর ২.৫ টাকা দাঁড়িকরসহ বিশেষ ৫ ধরনের কর আরোপ করে। তিতুমীরের অনুসারীরা ১৮৩০ সালের ৭ই আগস্ট এসব কর ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ১৮৩১ সালের ১৩ জুলাই কোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়। ইংরেজ যুগ্ম ম্যাজিস্ট্রেট চিন্তা করেছিলেন যে জমিদারদের কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করা যুক্তিযুক্ত হবে না। (চলবে)....
সূত্র: banglatribune

captcha